১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা নিয়ে আলোচনা করব।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: কারণ ও ফলাফল (A to Z আলোচনা)
ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে তাকালে কিছু ঘটনা জ্বলজ্বল করে ওঠে। এর মধ্যে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু একটি আন্দোলন ছিল না, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণের জেগে ওঠা। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক – সমাজের সব স্তরের মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায়।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অবিচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক বিরাট প্রতিবাদ। এই আন্দোলনের ঢেউ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তা পাকিস্তানের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং আমাদের স্বাধীনতার পথকে আরও খুলে দিয়েছিল। কেন ঘটেছিল এই বিরাট গণজাগরণ? এর ফলাফলই বা কী হয়েছিল? আসুন, আজ আমরা সহজ ভাষায় সেই ইতিহাস জানার চেষ্টা করি।
গণঅভ্যুত্থান কী? কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
গণঅভ্যুত্থান মানে হলো যখন দেশের সাধারণ মানুষ একসাথে কোনো অন্যায় বা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের বাংলাদেশ) মানুষ ঠিক এটাই করেছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকার ছিল সামরিক সরকার, মানে মিলিটারির শাসন। তারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের ন্যায্য অধিকার দিত না, বরং শোষণ করত। এই अन्याय আর সহ্য করতে না পেরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এই আন্দোলন এত বড় আকার নেয় যে একে শুধু আন্দোলন না বলে 'গণঅভ্যুত্থান' বা জনগণের জেগে ওঠা বলা হয়।
এই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি দেখিয়ে দিয়েছিল যে বাঙালিরা আর চুপ করে থাকবে না। তারা তাদের অধিকার চায়। এই আন্দোলনের ফলেই তখনকার শক্তিশালী শাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। এটি আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং স্বাধীনতার লড়াইকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পেছনের কারণগুলো
কোনো বড় ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে না। এর পেছনে অনেক দিনের জমা হওয়া ক্ষোভ ও কারণ থাকে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পেছনেও ছিল অনেকগুলো কারণ। আসুন, মূল কারণগুলো জেনে নিই:
১. পূর্ববর্তী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস
১৯৬৯ সালের আগে বাঙালিরা বেশ কয়েকটি বড় আন্দোলনে সফল হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এর মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালিরা রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করেছিল। এরপর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয় প্রমাণ করেছিল যে মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের চায় না। এই আগের আন্দোলনগুলোর সাফল্য মানুষকে সাহস জুগিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, এক হয়ে লড়লে জয় পাওয়া সম্ভব। এই আত্মবিশ্বাস ১৯৬৯ সালে বিশাল গণঅভ্যুত্থান তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।
২. পাকিস্তানি শাসকদের চরম অবিচার ও বৈষম্য
পাকিস্তান নামের দেশটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মানুষকে অবহেলা করত। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে লোকসংখ্যা বেশি ছিল, কিন্তু সব সুযোগ-সুবিধা পেত পশ্চিম পাকিস্তানিরা।
- চাকরি: সরকারি বড় বড় চাকরিতে বাঙালিদের নেওয়া হতো খুব কম। মিলিটারিতেও বাঙালির সংখ্যা ছিল নগণ্য।
- ব্যবসা-বাণিজ্য: ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশিরভাগ সুযোগ পেত পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় পশ্চিমে বড় বড় কলকারখানা হতো।
- উন্নয়ন: রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল তৈরির জন্য বেশিরভাগ টাকা খরচ করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাট বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো, তার বেশিরভাগই চলে যেত পশ্চিমে।
- নিরাপত্তা: ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যখন পাকিস্তানের যুদ্ধ লাগে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাঙালিরা বুঝতে পারে, শাসকরা তাদের সুরক্ষার কথা ভাবে না।
এই সব অবিচার আর বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ জমা হচ্ছিল, যা ১৯৬৯ সালে আন্দোলনের রূপ নেয়।
৩. ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন: বাঙালির মুক্তির সনদ
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ৬টি দাবি তুলে ধরেন। এই দাবিগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের মূল চাবিকাঠি। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা মুদ্রা, আলাদা অর্থনীতি এবং নিজেদের শাসন নিজেদের হাতে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
সাধারণ মানুষ এই ৬ দফাকে তাদের বেঁচে থাকার দাবি, নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার পথ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা বুঝতে পারে, ৬ দফা বাস্তবায়ন হলেই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি মিলবে। এই ৬ দফার পক্ষে জনমত তৈরি হয় এবং এটি মানুষকে ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে प्रेरित (উৎসাহিত) করে। আইয়ুব সরকার ৬ দফাকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মানুষ আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
৪. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: বঙ্গবন্ধুকে দমানোর চেষ্টা
যখন ৬ দফার পক্ষে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা এক হচ্ছিল, তখন ভয় পেয়ে যায় আইয়ুব সরকার। তারা বঙ্গবন্ধুকে এবং বাঙালির এই জাগরণকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাই ১৯৬৮ সালে তারা একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এই মামলার নাম দেওয়া হয় 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য', যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতি পায়।
সরকার অভিযোগ করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ভারতের সাথে মিলে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য গোপন পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র করছেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে জেলে ভরা হয় এবং ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে এক বিশেষ ট্রাইবুনালে এই মামলার বিচার শুরু হয়।
কিন্তু মানুষ বুঝে ফেলেছিল যে, এটি একটি সাজানো নাটক। বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়াই এর মূল উদ্দেশ্য। এই মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে মানুষ প্রচণ্ডভাবে রেগে যায় এবং ফুঁসে ওঠে। তারা তাদের প্রিয় নেতার মুক্তি এবং এই মামলার প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা গণঅভ্যুত্থানকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
৫. বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন
আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করায় এবং তাকে গ্রেফতারের পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আরও বেশি করে তার পক্ষে চলে আসে। তারা বুঝতে পারে, বঙ্গবন্ধু তাদের মুক্তির জন্য লড়ছেন বলেই তাকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। ছাত্র-জনতা শুধু ৬ দফার জন্যই নয়, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যও রাস্তায় নেমে পড়ে। সবার মুখে স্লোগান ওঠে – "জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব"। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এই ভালোবাসা ও সমর্থন গণঅভ্যুত্থানকে এক বিশাল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত করে।
৬. স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের শাসনের প্রতি ঘৃণা
আইয়ুব খান ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সামরিক শাসক এবং তার শাসনে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। মানুষের কথা বলার অধিকার ছিল না, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না। তিনি 'মৌলিক গণতন্ত্র' নামে এক অদ্ভুত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করেন, যেখানে সাধারণ মানুষের সরাসরি ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল সীমিত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই স্বৈরাচারী শাসন আর মেনে নিতে পারছিল না। তারা গণতন্ত্র এবং নিজেদের অধিকার চাইছিল। আইয়ুব খানের প্রতি এই জমানো ক্ষোভ ও ঘৃণা গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
৭. সরকারের দমননীতি ও নির্যাতন
যখন মানুষ তাদের অধিকারের জন্য কথা বলতে শুরু করে, আন্দোলন করতে শুরু করে, তখন আইয়ুব সরকার তাদের উপর চরম নির্যাতন চালায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হয়। মিছিলে গুলি চালানো হয়, অনেককে গ্রেফতার করা হয়, জেলে ভরা হয়। কিন্তু সরকারের এই দমননীতি উল্টো ফল দেয়। মানুষ ভয় পাওয়ার বদলে আরও বেশি সাহসী হয়ে ওঠে। নির্যাতন যত বাড়ে, আন্দোলন তত তীব্র হয়।
৮. আসাদ ও সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু: আন্দোলনে নতুন আগুন
আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ঘটে যায় দুটি মর্মান্তিক ঘটনা যা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করে।
- আসাদের শাহাদাত (২০ জানুয়ারি ১৯৬৯): ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (আসাদ) ছাত্রদের এক মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনায় ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আসাদের রক্ত আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। আজকের ঢাকার আসাদগেট তার নামেই পরিচিত।
- সার্জেন্ট জহুরুল হকের শাহাদাত (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯): আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। সরকারিভাবে বলা হয় তিনি নাকি পালানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সবাই বুঝেছিল এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মানুষ ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটে যায়, বিভিন্ন সরকারি ভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এই হত্যাকাণ্ডগুলো মানুষের মনে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল, তা যেন আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। তারা বুঝতে পারে, এই জালিম সরকারের পতন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
৯. জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালিদের মধ্যে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে এক নতুন চেতনার জন্ম হয়। তারা বুঝতে পারে, তারা পাকিস্তানি শাসকদের থেকে আলাদা, তাদের নিজস্ব একটি পরিচয় আছে। এই চেতনাকে বলা হয় 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ'। বছরের পর বছর ধরে চলা শোষণ আর বঞ্চনা এই চেতনাকে আরও শক্তিশালী করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনারই এক বিষ্ফোরন। মানুষ শুধু অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক মুক্তিই চায়নি, তারা নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়েও লড়েছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল ও তাৎপর্য
এই বিশাল গণজাগরণের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি শুধু আইয়ুব খানের পতনই ঘটায়নি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিল। আসুন, এর প্রধান ফলাফলগুলো দেখি:
১. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি
গণআন্দোলনের চাপে ভীত হয়ে পড়েছিল আইয়ুব সরকার। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তারা বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে। ১৯৬۹ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার সকল আসামিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। এটি ছিল জনগণের বিশাল এক বিজয়।
২. শেখ মুজিবের 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি লাভ ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিন, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক বিশাল গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ তাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধিটি জনগণের মনের কথারই প্রতিফলন ছিল। এই ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন পুরো বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়।
৩. ২১শে ফেব্রুয়ারির ছুটি পুনর্বহাল
১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেছিল যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে সেই ছুটি বাতিল করে দেন। এটি ছিল বাঙালির চেতনার উপর আঘাত। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকার বাধ্য হয় আবার ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করতে।
৪. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও গণজাগরণ
গণঅভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মানুষ সরকারের আইন মানতে অস্বীকার করে। মিছিল, মিটিং, হরতাল, ধর্মঘট চলতে থাকে। কলকারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দেয়। সরকারি অফিস-আদালতেও কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পুরো দেশ যেন জনগণের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এটি আইয়ুব সরকারের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।
৫. গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ
পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য আইয়ুব খান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বৈঠকে যোগ দিয়ে ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফা দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ও আইয়ুব খান এই দাবিগুলো মানতে রাজি হননি। ফলে আলোচনা ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এই বৈঠকের আগেই একে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আলোচনার মাধ্যমে কিছু হবে না, সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, আলোচনার পথে বাঙালিদের অধিকার আদায় সম্ভব নয়।
৬. আইয়ুব খানের পতন
গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর এবং আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকলে আইয়ুব খান বুঝতে পারেন যে তার ক্ষমতা ধরে রাখা আর সম্ভব নয়। তিনি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানকে সরিয়ে দেন, কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি শান্ত হয় না। অবশেষে, ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে, সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দেশে আবার জারি হয় সামরিক শাসন। যদিও আইয়ুবের পতন ছিল একটি বড় ঘটনা, কিন্তু সামরিক শাসনের অবসান না হওয়ায় জনগণের আসল মুক্তি আসেনি।
৭. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন
ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে বুঝতে পারেন যে, নির্বাচন দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জনগণের চাপ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। এই নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন।
এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে এক অভাবনীয় বিজয় লাভ করে। জাতীয় পরিষদের (পাকিস্তানের পার্লামেন্ট) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের (পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব আইনসভা) ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। এই নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ৬-দফার পক্ষে এবং তারা বঙ্গবন্ধুকেই তাদের নেতা মানে। এই ফলাফলই পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়।
৮. গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ
গণঅভ্যুত্থান মানুষের মনে সাহস জুগিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারী শাসন মেনে নেওয়া যায় না। নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে হয়। এই আন্দোলন মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা (কথা বলার অধিকার) এবং নিজেদের শাসন নিজেরা করার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। মানুষ যেকোনো ত্যাগের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে শুরু করে। এই গণতান্ত্রিক মানসিকতাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শক্তি。
৯. স্বাধীনতার পথে চূড়ান্ত যাত্রা
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে বলা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি মহড়া। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে একসাথে থাকা আর সম্ভব নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেওয়া হলো না, তখন বাঙালিরা চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। ১৯৬৯-এর অভিজ্ঞতা তাদের সাহস জুগিয়েছিল। তাই বলা যায়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পথ তৈরি করে দিয়েছিল। এই পথ ধরেই লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা।
উপসংহার
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালির সম্মিলিত প্রতিবাদ। এই আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল শহর থেকে গ্রামে, ছাত্র থেকে শ্রমিকের মাঝে। এর ফলে শুধু একজন স্বৈরাচারী শাসকের পতনই ঘটেনি, বরং একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির একক নেতা, আমাদের 'বঙ্গবন্ধু'। এই অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় অধ্যায়, যা সরাসরি আমাদের স্বাধীনতার পথ তৈরি করে দিয়েছিল। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্ব অপরিসীম এবং তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
১. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কী?
উত্তর: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) একটি বিশাল ছাত্র-জনতার আন্দোলন। এটি পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল এবং এর ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে।
২. গণঅভ্যুত্থানের প্রধান কারণগুলো কী ছিল?
উত্তর: প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবিকে অগ্রাহ্য করা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হয়রানি করা এবং আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসন ও দমননীতি।
৩. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কী?
উত্তর: এটি ছিল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আরও ৩৪ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। অভিযোগ ছিল তারা ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছিলেন। কিন্তু জনগণ এটিকে একটি সাজানো মামলা হিসেবে দেখেছিল।
৪. গণঅভ্যুত্থানের ফলে সবচেয়ে বড় অর্জন কী ছিল?
উত্তর: গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি। এছাড়া আইয়ুব খানের পতন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথ খুলে যাওয়াও ছিল বড় অর্জন।
৫. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কীভাবে স্বাধীনতার পথে সাহায্য করেছিল?
উত্তর: এই আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক ঐক্য সৃষ্টি করে এবং তাদের অধিকার আদায়ে আরও সাহসী করে তোলে। এটি প্রমাণ করে যে পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের দাবি মানবে না। এর ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মানসিক ভিত্তি তৈরি হয়।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান কারণ ও ফলাফল বিস্তারিত আলোচনা এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url