প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি ও পরিসর

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি ও পরিসর নিয়ে আলোচনা করব।

আমাদের চারপাশের বিশ্ব - পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি, নদী - এই সবকিছুই প্রাকৃতিক ভূগোলের অধ্যয়ন বিষয়। এটি পৃথিবীর প্রাকৃতিক দৃশ্যপটল, প্রক্রিয়া, এবং সেগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। "প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি ও পরিসর" শিরোনামটি এই বিষয়ের গভীরে ঢুকে পড়ার দুর্দান্ত সুযোগ দেয়।

প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি ও পরিসর

ভূগোল (Geography)

মানুষের বাসযোগ্য গ্রহ হলো পৃথিবী। আমাদের এ পৃথিবীর সৃষ্টি কবে, কখন, কীভাবে তা জানার জন্য মানুষের আগ্রহের অন্ত নেই। সাধারণভাবে বলা যায়, আমাদের আবাসভূমি হিসেবে পৃথিবী এবং পৃথিবীর কী? কোথায়? কখন? কেন? কীভাবে? ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যে শাস্ত্রের জন্ম তাই ভূগোল।

ভূগোলের ইংরেজি প্রতিশব্দ Geography. এ শব্দটি গ্রিস দেশীয় প্রখ্যাত ভূগোলবিদ ইরাটসথেনিস সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। Geography শব্দটি মূলত দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। Geo এবং Graphy। এখানে Geo শব্দের অর্থ পৃথিবী বা ভূ। Graphy শব্দের অর্থ বর্ণনা। অর্থাৎ পৃথিবীর বর্ণনাই হলো ভূগোল।

ডাডলি স্ট্যাম্পের (Dudley Stamp)-এর মতে, "পৃথিবী ও তার অধিবাসীর বর্ণনাই হলো ভূগোল।" আবার রিচার্ড হার্টশোন বলেন, "ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের যথাযথ যুক্তিসংগত ও সুবিন্যস্ত বিবরণই হলো ভূগোল।" অধ্যাপক ই. এ. ম্যাকনি বলেন, "মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ভৌত ও সামাজিক পরিবেশে মানুষের কর্মকাণ্ড ও জীবনধারার বর্ণনাই ভূগোল।" তাই বলা যায়, মানুষের জীবনের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

আর প্রকৃতিকে নিয়েই ভূগোলের বিষয়বস্তু। তাই বলা হয় ভূগোল হলো সব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের জননী। ভূগোল বিষয়টিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (ক) প্রাকৃতিক ভূগোল (Physical Geography), (খ) মানব ভূগোল (Human Geography) ও (গ) পদ্ধতিগত ভূগোল (Methodological Geography)

প্রাকৃতিক ভূগোল (Physical Geography)

প্রাকৃতিক ভূগোল ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক ধরন এবং পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে আলোচনা করে থাকে। ভূগোলের সংজ্ঞার আলোকে প্রাকৃতিক ভূগোল সম্পর্কে বলা যায়, 'প্রাকৃতিক ভূগোল' হলো প্রাকৃতিক প্রপঞ্চসমূহের স্থানিক ও কালিক বিশ্লেষণ।

আঞ্চলিক স্কেলের প্রেক্ষিতে এর সংজ্ঞার্থে বলা যায়, "প্রাকৃতিক প্রপঞ্চসমূহের আঞ্চলিক তারতম্য বিশ্লেষণ করাকে প্রাকৃতিক ভূগোল বলা যায়।" কার্ল রিটারের মতে, "প্রাকৃতিক ভূগোল হচ্ছে বিজ্ঞানের সেই শাখা যা পৃথিবীর সমস্ত অবয়ব, বৈচিত্র্য ও সম্পর্কসহ একটি স্বতন্ত্র একক হিসেবে বিচার করে।

"আবার রিচার্ড হার্টশোন-এর মতে," ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের সঠিক সুবিন্যস্ত ও যুক্তিসংগত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা সরবরাহ করা প্রাকৃতিক ভূগোলের কাজ।" Christine E Memichael (2010) Physical Geography-তে প্রাকৃতিক ভূগোলের সংজ্ঞায় বলেন, প্রাকৃতিক ভূগোল ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক প্যাটার্ন বা ধরন এবং পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। মানুষ ও প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়াও এর আওতাভুক্ত এবং এটা ভূগোলের একটা উপক্ষেত্র।

প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি

প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন হচ্ছে। বৈজ্ঞানিকগণ, ভূগোলবিদগণ প্রতিনিয়ত এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর অনেক রহস্য আজও মানুষের অজানা। আবার দেখা যায়, প্রাকৃতিক ভূগোলের গবেষণালব্ধ ফল দীর্ঘদিন স্থায়ী থাকে না। বিভিন্ন কারণে প্রকৃতির পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

এ কারণেই পরিবর্তনশীলতা প্রাকৃতিক ভূগোলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার প্রভাব ভূপৃষ্ঠের প্রাণিজগৎ, উদ্ভিদজগৎ ও মানবজাতির উপর পড়ছে। প্রাকৃতিক ভূগোল সাধারণত তত্ত্ব বা বর্ণনা প্রধান নয়। মূলত তথ্য উদ্‌ঘাটন ও তথ্য গবেষণা প্রাধান্য প্রবল। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য উদ্‌ঘাটনের জন্য প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি এবং গবেষণার ক্ষেত্র হলো সমগ্র পৃথিবী।

মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হলো সৌরজগতের উৎপত্তি, অবস্থান, গাণিতিক পরিমাপ যেমন প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত তেমনি পৃথিবীর আকার, আকৃতি, পৃথিবীর বার্ষিক ও আহ্নিক গতি, পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্য, অভ্যন্তরীণ অবস্থা, পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়া, ভূ-আলোড়ন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বর্ণনা করাও প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি।

আবার পৃথিবীর জলবায়ু, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডলীয় পরিবেশ, পৃথিবীর প্রাণিজগতের প্রয়োজনীয় শক্তির উৎস, সৌরশক্তির বিন্যাস, পানিচক্র, পানির পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন চক্র এবং পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ নিয়ে বর্ণনা করা প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি।

প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিসর

প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিসর ব্যাপক। পৃথিবীর জন্ম, আকার, আয়তন পৃথিবীর উপগ্রহ, চন্দ্র, সূর্যের অবস্থান, পৃথিবীর গতি, ভূপ্রকৃতি, শিলা, খনিজ, ভূমিরূপ, নদ-নদী জলবায়ু ইত্যাদি বিষয় প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিসরভুক্ত। তাই আলোচনার সুবিধার জন্য প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিসরকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে বিভক্ত করে আলোচনা করা হলো-

  1. ভূমিরূপবিদ্যা (Geomorphology)
  2. জলবায়ুবিদ্যা (Climatology)
  3. সমুদ্রবিদ্যা (Oceanography)
  4. জীবভূগোল (Biogeography)

১. ভূমিরূপবিদ্যা (Geomorphology): ভূমিরূপবিদ্যায় পৃথিবীর সৃষ্টি, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, ভূআলোড়ন, পাহাড়, পর্বত, বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ, নদ-নদীর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, বায়ুর কার্য, হিমবাহের কার্য প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে। এ শাখা থেকে আরও জানা যায়, পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত নানাপ্রকার মতবাদ, সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় পৃথিবীর আকার ও আয়তন কেমন ছিল তার বিবরণ, ভূমিকম্প ও ভূআলোড়নের ফলে, পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে যে নানাপ্রকার ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জ্ঞান লাভ করা যায়।

২. জলবায়ুবিদ্যা (Climatology): জলবায়ুবিদ্যায় বায়ুস্তর বিন্যাস, বায়ুর উপাদান, বায়ুর গঠন, বায়ুর ধর্ম, বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর শ্রেণিবিভাগ, বায়ুপুঞ্জ, বায়ুপ্রাচীর, ঘূর্ণিবাত, প্রতীপ ঘূর্ণিবাত, বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প, বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিপাতের কারণ, শ্রেণিবিভাগ, আবহাওয়া ও জলবায়ু, জলবায়ুর প্রকারভেদ, জলবায়ু অঞ্চল প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

৩। সমুদ্রবিদ্যা (Oceanography): এ শাখা সমুদ্রের উৎপত্তি, আকার, আয়তন, পৃথিবীর সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, সাগরতলের ভূপ্রকৃতি, সমুদ্রস্রোতের কারণ, সমুদ্রস্রোত, সমুদ্র তরঙ্গ ও এর কার্য, সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণি ও উদ্ভিদের বিন্যাস, জোয়ার-ভাটা, জোয়ার-ভাটার প্রভাব, স্থলভাগের উপর সমুদ্রের প্রভাব প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

৪. জীবভূগোল (Biogeography): জীবভূগোল ভূগোলের নতুন একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ শাখার অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হচ্ছে স্থানভেদে উদ্ভিদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, পরিবেশের ওপর উদ্ভিদের প্রভাব, অঞ্চলভিত্তিক উদ্ভিদের বিস্তরণ, উদ্ভিদের বিন্যাস, পশুপাখি ও মানুষের ওপর উদ্ভিদের প্রভাব, মানুষ ও প্রাণিকুলের বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ু, মৃত্তিকা ও অন্যান্য ভৌগোলিক উপাদানসমূহ। এ শাখা থেকে পৃথিবীর ভূআচ্ছাদন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করা যায় এবং কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। উপরিউক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও মৃত্তিকাবিদ্যা, মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা প্রাকৃতিক ভূগোলের আওতাভুক্ত।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রকৃতি ও পরিসর এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url