গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো নিয়ে আলোচনা করব।

গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো

গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মূল বৈশিষ্ট্য/মূল নীতিসমূহ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে শান্তিপূর্ণ পথে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করে। বৈপ্লবিক পথকে অনুসরণ না করে, বিবর্তনমূলক ধারণাকে অবলম্বন করে এবং বিবর্তনের পথ ধরে সমাজ-সংস্কারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলাকে গণতান্ত্রিক সমাজবাদ বলা হয়।

গণতান্ত্রিক সমাজবাদের প্রথম প্রবক্তা এডওয়ার্ড বার্নস্টাইন (Edward Bernstein) বলেছেন যে, সমাজতন্ত্র বিবর্তনের পথ ধরেই আসতে পারে।, বৈপ্লবিক পথে না গিয়েই ট্রেড ইউনিয়ন ও সমবায় সমিতিগুলির দ্বারা সাংবিধানিক উপায়ে সমাজতান্ত্রিক দল নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের মাধ্যমে এইরূপ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

মার্কসবাদ যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী তা বৈপ্লবিক পথে সম্পন্ন হতে পারে, কিন্তু বার্নস্টাইন মার্কসবাদের সিদ্ধান্তকে সংশোধন করেছেন এবং তিনি বিপ্লবের পরিবর্তে সংস্কার সাধনের মাধ্যমে, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। এইরূপ সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (Democratic Socialism) নামে পরিচিত। গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মৌলনীতি বা মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা মার্কসবাদীদের মতো সমাজবিপ্লবের তত্ত্বকে মেনে নেননি। তাঁরা মনে করেন, শান্তিপূর্ণ পথে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। মার্কসবাদীরা যেমন মনে করেন যে, প্রোলেতারীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবের পথ ধরতে হবে, গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা তা মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন যে, ট্রেড ইউনিয়ন ও সমবায় সমিতিগুলির মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক দল সাংবিধানিক উপায়ে শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

রাষ্ট্র সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের আলোচনা

গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের আলোচনায় রাষ্ট্র নিয়ে বিবর্তন ধারাকে আলোকপাত করা হয়েছে। মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব এই আলোচনায় স্থান পায়নি। মার্কসবাদ রাষ্ট্রকে শ্রেণিশাসনের যন্ত্র হিসেবে দেখেছে। অর্থাৎ মার্কসবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল এক শ্রেণির ওপর অপর এক শ্রেণির আধিপত্য টিকিয়ে রাখার যন্ত্র।

গণতান্ত্রিক সমাজবাদ মার্কসীয় চিন্তাধারাকে কোনোভাবে গ্রাহ্য বলে মনে করে না। তাঁরা রাষ্ট্রকে দেখেছেন একটি শ্রেণি-নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাঁদের দৃষ্টিতে সমাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় একটি প্রতিষ্ঠান হল রাষ্ট্র।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি

গণতান্ত্রিক সমাজবাদ অনুসারে, শুধুমাত্র সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিকতা এবং রাষ্ট্র কাঠামোতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মার্কসবাদে বলা হয় রাষ্ট্রের বিলোপের পর সমাজব্যবস্থা হবে কমিউন পরিচালিত। গণতান্ত্রিক সমাজবাদ এই ধারণাটির সমালোচনা করে এবং একে অবাস্তব বলে মনে করে।

গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের মতে, রাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংস না করেও বা কমিউন শাসনব্যবস্থা কায়েম না করেও স্থানীয় শাসনপ্রতিষ্ঠানগুলি দ্বারা পরিচালিত শাসনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কায়েম করা সম্ভব। অর্থাৎ বৈপ্লবিক পদ্ধতির ওপর গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা আস্থা রাখতে পারেননি।

মিশ্র অর্থব্যবস্থা

গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা ব্যক্তি-মালিকানার বিলোপের কোনো পঙ্খার কথা বলেননি। তাঁরা চেয়েছেন মিশ্র-অর্থনীতির তত্ত্বটিকে প্রয়োগ করতে। মিশ্র অর্থনীতিতে ব্যক্তি-মালিকানার পুরোপুরি বিলোপ সাধনের কথা বলা হয় না। বরং তাঁরা চান ব্যক্তি-মালিকানার পাশাপাশি রাষ্ট্রের হাতেও উৎপাদনের উপাদানগুলির বা উপকরণগুলির ডার থাকুক।

এরূপ ব্যবস্থায় আয় ও ধন-বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসান ঘটেনা। তবে চেষ্টা করা হয় যাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকটা কমে যায়। এককথায় বলা যায় যে, মিশ্র অর্থব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রসারিত হয়। এইভাবে মিশ্র অর্থব্যবস্থার দ্বারা রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানাকে পাশাপাশি রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

সামাজিকীকরণকে গুরুত্ব দান

গণতান্ত্রিক সমাজবাদে জাতীয়করণ (nationalization) বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। বরং বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে সামাজিকীকরণ (socialization)-এর বিষয়টি। এই কারণে মুনাফা যাতে যথাযথভাবে বষ্টিত হয় এবং সামাজিক ঐক্য যাতে রক্ষিত হয় তার জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে তাঁরা কামনা করেছেন।

ভোটাধিকারের প্রকৃতি

গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা ভোটাধিকারের নীতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাদের মতে, যে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক জনসমর্থিত সেই রাষ্ট্র মানব কল্যাণের পরিপন্থী হতে পারে না। ব্যক্তিকে যদি ভোটাধিকার দান করা যায় তাহলে ভোটাধিকার-প্রাপ্ত ব্যক্তিরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তিদেরই সংসদে মনোনীত করার সুযোগ লাভ করবে। এর ফলে সাংবিধানিক পথেই গণতান্ত্রিক সমাজবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে।

সমষ্টিগত ধারণা

গণতান্ত্রিক সমাজবাদ মনে করে যে, শ্রমিকশ্রেণির হাতে শিল্পের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ন্যস্ত না করে বরং তা সমাজের হাতেই রেখে দেওয়া ভাল। তাই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক বিষয়টিকে ধরে রাখা হয়েছে।

তাঁদের মতে, পুঁজিবাদী শোষণের হাত থেকে রাষ্ট্রকে তাঁর প্রশাসন কাঠামোটিকে মুক্ত করে সমাজব্যবস্থাকে যদি গণতান্ত্রিক সমাজবাদের অভিমুখী করা যায় তাহলে ব্যক্তি লাভ করবে তার স্বাধীনতা-ভোগের সুযোগ।

বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা

গণতান্ত্রিক সমাজবাদীরা রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের পথে হাঁটতে চাননি। তাঁরা চেয়েছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক উপায়ে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন। এ বিষয়ে তাঁদের পদ্ধতিটি হল পার্লামেন্টে আইন পাসের মধ্য দিয়ে পুঁজিপতিদের ক্ষমতা একদিকে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা এবং অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকে সম্ভব করে তোলা।

সমালোচনা

গণতান্ত্রিক সমাজবাদের বিষয়বস্তুটি বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে।

প্রথমত, সমালোচকদের মতে, গণতান্ত্রিক সমাজবাদে অপচয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগহীনতা, আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য প্রভৃতি প্রশ্রয় পেয়েছে বলে তা শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ মনে করেন এই মতবাদ অবাস্তব। কারণ, রাষ্ট্র কাঠামো টিকে থাকলে সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে না। কারণ রাষ্ট্র হল শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার। BSTE
তৃতীয়ত, মার্কসবাদীদের মতে, সমাজে শ্রেণিবৈষম্য টিকে থাকলে ব্যক্তির সাংস্কৃতিক ও মানসিক উন্নতি বিধান বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরিশেষে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক সমাজবাদে মিশ্র অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ একই সঙ্গে শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ সাধন করতে পারে না।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। গণতান্ত্রিক সমাজবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url