মুরগির বিভিন্ন পালন পদ্ধতি | মুক্ত পালন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে মুরগির বিভিন্ন পালন পদ্ধতি | মুক্ত পালন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ নিয়ে আলোচনা করব।

মুরগির বিভিন্ন পালন পদ্ধতি

মুরগির বিভিন্ন পালন পদ্ধতি

মুরগি পালনের জন্য পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত আছে। মুরগি পালনকারীর অবস্থান ও অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে উপযোগী পদ্ধতিতে পালন করে থাকে। এ পদ্ধতিগুলো মূলত ৩ প্রকারের।

যথা- (ক) মুক্ত পালন অর্থাৎ ছাড়া অবস্থায় স্বাধীনভাবে পালন, (খ) অর্ধ মুক্ত পালন অর্থাৎ ঘেরা দিয়ে কিছুটা জায়গার মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা দিয়ে পালন এবং (গ) সম্পূর্ণ আবদ্ধ অর্থাৎ ঘরের মধ্যে লিটার দিয়ে বা খাঁচায় পালন। নিচে এসব পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:-

ক. মুক্ত পালন: এ পদ্ধতিকে পারিবারিক খামার বলা যায়। গ্রামাঞ্চলে বসতবাড়ির আঙ্গিনা, রাস্তাঘাট, মাঠ, ক্ষেত খামারে মুক্তভাবে মুরগি বিচরণ করে। এ সময় তারা পোকামাকড়, ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ফসলের দানা, লতা-পাতা ঠুকরিয়ে খায়। এজন্য তেমন কোনো লোকজনের দরকার হয় না।

এমনকি খাদ্যও দেওয়ার দরকার হয় না। তবে, সকালে ঘর থেকে মুরগি ছাড়ার সময় কিছু খাবার ছিটিয়ে দেওয়া হয়, এরপর তারা চরে খাওয়ার জন্য বের হয়ে যায়। সন্ধ্যার সময় আবার আপনা-আপনি মুরগি ঘরে চলে আসে। মুরগি ঘরে উঠার পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাতে মুরগির নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ১০-১৫ টি মুরগির জন্য ১ মিটার উঁচু × ১.২ মিটার চওড়া ১.৫ মিটার লম্বা ঘর করা যায় (মুরগির সংখ্যার উপর নির্ভর করে ঘর ছোট/বড় হতে পারে।)। তবে ঘরের বেড়া বাঁশের চটা/পাটকাঠি/কাঠের তক্তা/তারের জালি দিয়ে তৈরি করা যায়। গ্রামাঞ্চলে মাটির দেয়াল দিয়েও তৈরি করা হয়।

মাটির দেয়াল/কাঠের তক্তা দিয়ে ঘেরা দিলে বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্র রাখতে হয়। ঘরের চালা খড়/টিন/টালি দিয়ে এবং দরজায় বাঁশের চাটাইয়ের সাথে পলিথিন দিয়ে তৈরি করা যায়। ঘরের মেঝেতে ধানের তুষ, করাতের গুঁড়া বা ছাই ২.৫ সে. মি. পুরু করে বিছিয়ে দিতে হয়। সাধারণত মুক্ত পালন পদ্ধতিতে দেশি জাতের মুরগি ব্যবহার করা হয়।

মুক্ত পালন পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:

  1. সূর্যের কিরণ সরাসরি পাওয়ার ফলে ভিটামিন 'ডি' প্রকৃতিগতভাবে শরীরে তৈরি হয়।
  2. সবুজ শাকসবজি, ঘাস পাতা খাওয়ার ফলে জ্যান্থফিল পায়, যা ডিমের কুসুমকে হলুদ করে। বাজারে হলুদ কুসুমওয়ালা ডিমের চাহিদা বেশি হয়।
  3. মুরগি খোলামেলা পরিবেশে দৌড়াদৌড়ির সুযোগ পায় বলে শরীর ভালো থাকে, দেহের গঠন সুঠাম হয় এবং মাংসপেশি মজবুত ও পুষ্ট হয়। ফলে মাংস সুস্বাদু হয় বলে বাজারে এদের চাহিদা বেশি হয়।
  4. সূর্য কিরণ মুরগির দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  5. মুক্ত পালন পদ্ধতিতে বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না, বাড়তি লোকবলের প্রয়োজন হয় না। এ পদ্ধতি সহজ এবং কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না।
  6. মুরগি নিজেদের খাদ্য নিজেরাই সংগ্রহ করে বলে খরচ খুব সামান্যই হয়।
  7. মুক্ত পালন পদ্ধতিতে আধুনিক ও ব্যয়বহুল ঘর তৈরির প্রয়োজন হয় না।

মুক্ত পালন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ:

  1. মুক্ত পালন পদ্ধতিতে মুরগির বিচরণের জন্য অনেক জায়গার প্রয়োজন হয়।
  2. এতে মুরগি যত্রতত্র ঘুরাঘুরির সময় বিষ্ঠা ত্যাগ করে অনেক ভালো জায়গা নোংরা করে থাকে। পাড়া- প্রতিবেশীদের সাথে অনেক সময় ঝগড়ার সৃষ্টি হয়।
  3. মুক্ত পালনের মুরগি বাড়ির আশেপাশের জমির ফসল ও শাকসবজি নষ্ট করে ফেলে। বিশেষ করে বীজতলা বেশি নষ্ট করে থাকে। অন্যদিকে ফসল ও বীজতলা রক্ষায় বালাইনাশক ব্যবহার করাও সমস্যা হয়। কেননা বালাইনাশকে মৃত পোকা মাকড় খেয়ে মুরগি মারা যেতে পারে।
  4. মুক্ত পালনে মুরগি কুড়িয়ে খাদ্য খাওয়ার সময় নোংরা, পচা, নর্দমার কীট ও পানি খেয়ে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  5. ডিম পাড়ার নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় অনেক সময় কোথায় ডিম পাড়ে তা জানা যায় না। ।
  6. শিয়াল, বেঁজি, বাজপাখি ইত্যাদি বন্যপ্রাণী মুরগিকে ধরে নিয়ে যায়
  7. মুরগির ছোঁয়াচে রোগ হলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়।
  8. মুরগি চুরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

খ. অর্ধমুক্ত পালন: বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে উন্নত জাতের মোরগ-মুরগি পালনের জন্য আধাছাড়া পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। এ পদ্ধতিতে যাদের বাড়ির সামনে ফাঁকা বা কিছুটা খালি জায়গা থাকে তারা অর্ধ মুক্তভাবে বা অর্ধ স্বাধীনভাবে মুরগি পালন করতে পারেন।

এ পদ্ধতিটি তেমন কিছুই নয়, মুরগি রাত্রে নিরাপদভাবে থাকার জন্য ঘরের সামনে খানিকটা খোলা জায়গায় লোহার জালি বা বাঁশের খাঁচা দিয়ে বেড়া/ঘেরা তৈরি করা হয়। বেড়াটি ৬-৭ ফুট উঁচু করা হয়। মুরগি দিনের বেলায় এ ঘেরার মধ্যেই চরে বেড়াবে, এর বাইরে যেতে দেওয়া হয় না।

অর্ধমুক্ত পালনের জায়গা নিচু ও স্যাঁতসেঁতে হলে সেখানে মুরগির রোগব্যাধি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দেখা গেছে মুরগি চরে বেড়ানোর জায়গার মাটি শুকনো ও জমি একটু ঢালু হলে খামারের জন্য আদর্শ জমি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

অর্ধমুক্ত পালন স্থানের আশপাশে বড় গাছ থাকা মোটেও ভালো না। এতে গাছের ছায়া পড়ায় মুরগি সূর্য কিরণ পায় না, গাছের মরা পাতা পড়ে জায়গা নোংরা ও দূষিত হয় এবং জায়গা স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে, যা মুরগির জন্য অস্বাস্থ্যকর।

অর্ধমুক্ত পালন পদ্ধতিতে রানে (ঘরের সামনের খোলা জায়গা) অর্থাৎ মুরগি দিনে চলাফেরার স্থান ঘরের চেয়ে অন্তত দ্বিগুণ হওয়া উচিত। এ পদ্ধতিতে ১০০- ১৫০টি উন্নত জাতের মুরগি পালন করার জন্য (ক) ঘর: ৬ মিটার (২০ ফুট) লম্বা, ৩ মিটার (১০ ফুট) প্রস্থ ও ২.৬ মিটার উঁচু (৮ ফুট) আকারের ঘর তৈরি করতে হবে।

(খ) রান: ১২ মিটার (৪০ ফুট) লম্বা, ৬ মিটার (২০ ফুট) প্রস্থ ও ৫.২ মিটার (১৬ ফুট) উঁচু বেড়া হলে ভালো হয়। বাড়ির পেছনে যদি অল্প জায়গা থাকে তাহলে সেখানে ঘিরে অর্ধমুক্ত পদ্ধতিতে মুরগি ভালোভাবেই পালন করা যায়।

এখানে উন্নত বিদেশি মুরগি পালনের মাধ্যমে দেশি মুরগির চেয়ে বেশি ডিম পাওয়া সম্ভব। এখানে সময়মতো বিশুদ্ধ পানি ও খাবার দিতে হয়, দিনে দুইবার ডিম সংগ্রহ করতে হয় এবং সন্ধ্যেবেলায় ঘরে তুলে দিতে হয়। এ ধরনের পালন পদ্ধতির মুরগিকে সকালে ও বিকালে খাবার দেওয়ার সময় তাদের খাদ্য গ্রহণ ও আচরণ স্বাভাবিক কি-না তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অস্বাভাবিক দেখলে চিকিৎসা করতে হয়।

অর্ধমুক্ত পালন পদ্ধতিতে ছাদের উপর মুরগি পালন ছাদের উপর মুরগি পালনে ডিপ লিটার পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো। ছাদে ২০ ফুট × ১৫ ফুট অর্থাৎ ৩০০ বর্গফুট জায়গায় প্রায় ৭৫টি মুরগি খুব সহজেই পালন করা যায়। আর এদের ঘোরাফেরার জন্য অতিরিক্ত কিছু জায়গা থাকলে খুবই ভালো।

ছাদে যে দিকটায় আধা দেয়াল থাকে সে দিকটা হতে ঘর তৈরি করা সবচেয়ে ভালো। ছাদে বাতাস বেশি লাগে আবার গরম লাগে, তাই কিছুটা উঁচু করে ছিদ্রযুক্ত ইট দিয়ে দেয়াল তৈরি করে উপরের চালা পর্যন্ত কিছু অংশে তারের জালি দিয়ে ঘিরে ঘর তৈরি করা উচিত। বৃষ্টির সময় যাতে পানির ঝাপটা ঘরে ঢুকতে না পারে সে জন্য চালা বাড়িয়ে দিতে হয় এবং পানি দূরে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়।

অর্ধমুক্ত মুরগি পালনের ঘর তৈরি:

ঘরের বেড়া: ইট, সিমেন্ট, লোহা, কাঠ, বাঁশ, পাটকাঠি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা যায়।

ঘরের খুঁটি: কাঠ, বাঁশ, পিলার, লোহার পোল দিয়ে তৈরি করা যায়।

ঘরের চালা: খড়, শণ, গোলপাতা, টিন, পলিথিন কাগজ, ত্রিপল ইত্যাদি দিয়ে ছাদ তৈরি করা যায়। ঘরের মেঝে: ঘরের মেঝে পাকা, আধা পাকা, কাঁচা, তক্তার বা বাঁশের পাটাতন দিয়ে এর উপর তুষ, কাঠের গুঁড়া, বাদামের খোসা, ছাই, খড় ছোট ছোট করে কেটে ৫ সে.মি. পুরু করে বিছিয়ে দেওয়া যায়।

মুরগির জন্য পানি ও খাবার পাত্র এ পাত্র রানের মধ্যে রাখা যায়। তবে বৃষ্টি ও দুর্যোগের সময় ঘরে বসাতে হয়। ডিম পাড়া মুরগির জন্য ছাই ও খড় দেওয়া ঝুড়ি/মাটির হাড়ি ঘরের মধ্যে' কোণার দিকে বসাতে হয়। প্রতি ৫টি ডিম পাড়া মুরগির জন্য একটি বাসা কাঠ বা টিন দিয়ে তৈরি করা যায়। ঘরের মাপ হবে ৩৫ সেমি. × ৩০ সেমি. × ৩০ সেমি.।

ডিম পাড়া মুরগির বাসার বৈশিষ্ট্য:

  1. বাসাটি ছায়াযুক্ত ও হালকা অন্ধকারযুক্ত স্থানে বসাতে হবে।
  2. বাতাস যুক্ত হলেও সরাসরি বাতাসের প্রবাহ যাতে ঢুকতে না পারে, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  3. ডিমের খোসা বা ভাঙা ডিম থাকলে লিটারসহ সরাতে হবে।
  4. লিটার অন্তত ৫-৭ সে.মি. পুরু ও শুকনা হতে হবে।

অর্ধমুক্ত মুরগি পালন পদ্ধতির সুবিধাসমূহ:

  1. সকাল ও সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত মুরগি রানের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় সূর্য কিরণ, আলো-বাতাস ও খোলামেলা পরিবেশ পায়।
  2. রানের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করার কারণে স্বাস্থ্যভালো থাকে ফলে চর্বি জমতে পারে না।
  3. খাবার ও পানি দেওয়া হয় বলে খাদ্য ও পানি সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকতে হয় না।
  4. রানের মধ্যে থাকার কারণে ঝোপ-ঝাড়ের বা নর্দমার কোনো ময়লা-আবর্জনার সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ পায় না, ফলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
  5. বাগান, বীজতলা বা শস্য ক্ষেতের ক্ষতি করতে পারে না বা আশপাশের বাড়িতে ঢুকে নোংরা করারও সুযোগ থাকে না।
  6. বন্য প্রাণী বা দুষ্টুলোক দ্বারা চুরি বা ক্ষতি হওয়ার সুযোগ থাকে না।
  7. রানে খাদ্য ও পানি দেওয়া সুবিধাজনক। আর উপরে নাইলন বা তারের জালি দিলে বন্যপাখি থেকেও নিরাপদ থাকে।
  8. কোনো মুরগি খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা থাকলে বা অসুস্থ হলে তা সহজে চিহ্নিত করা যায়।
  9. মুরগিকে দেওয়া পানি পড়ে ঘরের লিটার ভিজার সুযোগ থাকে না এবং তাদের বিষ্ঠাও ঘরের মধ্যে বেশি পড়তে পারে না।
  10. প্রজননের মোরগ বেশি কার্যকর হতে পারে।
  11. যেকোনো সময় মোরগ-মুরগির কাঙ্ক্ষিতটি সহজেই ধরার সুযোগ থাকে।

অর্ধমুক্ত মুরগি পালন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ:

  1. রানের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়ার সুযোগ অধিকাংশ পরিবারেই নাই।
  2. রানের ঘেরা ও প্রয়োজনে উপরের দিকে ঘেরা দিতে বাড়তি খরচ হয়।
  3. বৃষ্টি ও বর্ষার সময় রান শুকনা ও ভালো রাখা কঠিন হয়ে যায়।
  4. রানের খুঁটিতে বা ছাদে অনেক সময় কাক বা চিল মরা পাখি বা পশুর বর্জ্য নিয়ে এসে নোংরা করে। এমনকি সংক্রামক রোগও ছড়ায়।
  5. ঘর ও রান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে, জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে, খাদ্য ও পানির পাত্র দিতে কিছুটা খরচ করতে হয়।

গ. সম্পূর্ণ আবদ্ধ পদ্ধতি: অল্প স্থানে (কয়েক তলা হতে পারে) বহু সংখ্যক মুরগিকে একত্রে আটকিয়ে রাখা হয়। তবে সেখানে স্বাস্থ্য ভালো রাখার ও ডিম বা মাংস বেশি উৎপাদনের জন্য আরামপ্রদ পরিবেশ সৃষ্টির ব্যবস্থা করে মুরগি পালন করা হয়। এ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ আবদ্ধ মুরগি পালন পদ্ধতি বলা হয়। আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

মাচায় মুরগি পালন:

  1. বাঁশ/কাঠ/পিলার দিয়ে খুঁটি বানিয়ে মাচা তৈরি করা যায়।
  2. যেসব স্থানে প্রায়ই স্যাঁতসেঁতে থাকে সেখানে মাচায় মুরগি পালন করা হয়।
  3. মাচা তৈরির উপকরণ স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়, তাই তৈরি করা সহজ।
  4. ঘরের মেঝেতে একাংশে ২-৩ ফুট উঁচু করে মাচা তৈরি করা হয়।
  5. মাচায় বাঁশের/কাঠের/লোহার রডের ফাঁকা করে পাটাতন তৈরি করা হয় এবং ফাঁকা স্থান দিয়ে মুরগির বিষ্ঠা নিচে পড়ে যায়।
  6. মাচার উপর খাবার পাত্র, পানির পাত্র, ডিম পাড়ার বাসা স্থাপন করা যায়।
  7. ঘরের চারিধারে উপরের দিক দিয়ে নেট ব্যবহার করে তাতে চটের পর্দা ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে পর্দা উপরে জড়ায়ে রেখে দিলে ঘরে আলো বাতাস চলাচল করতে পারবে। তাতে মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
  8. বাঁচ্চা ব্রুডিং-এর জন্য তারের জাল/পাটাতনের উপর চাটাই বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বাচ্চা ব্রুডিং করা যায়।

খাঁচায় মুরগি পালন:

খাঁচায় মুরগি পালন করা একটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ মুরগি পালন পদ্ধতি। কাঠ, প্লাস্টিক, বাঁশ বা লোহার রড দিয়ে খাঁচা তৈরি করা যায়। মুরগির খাঁচা একক, দোতলা (একাধিক), কলোনী ধরনের বা বহুতলবিশিষ্ট হতে পারে। মোরগ-মুরগির সংখ্যা অনুপাতে খাঁচার দৈর্ঘ্য ও সংখ্যা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

খাঁচা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো- (ক) খাবার পাত্র খাঁচার সামনে চ্যানেলের ন্যায় থাকে। (খ) পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সামনে একটু উপরে চ্যানেলের ন্যায় থাকে। (গ) ডিম সংগ্রহের চ্যানেল সামনের দিকে একটু নিচে ঢালু থাকে। (ঘ) বিষ্ঠা ও ময়লা জমার ট্রে সরাসরি নিচের দিকে থাকে।

খাঁচায় মুরগি পালনে সতর্কতা:

মুরগি খাঁচায় আবদ্ধ থাকায় তারা সম্পূর্ণ পরাধীন জীবনযাপন করে। এদের খাদ্য মিশ্রণে কোনো উপাদানের ত্রুটি/ঘাটতি থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। যেমন- ডিম উৎপাদন কমে যাবে, অসুস্থ হবে, নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিবে, বিষণ্ণ হয়ে পড়বে ইত্যাদি।

খাঁচার ঘষায় শরীর হতে রক্তপাত হতে পারে। তাই রক্তপাত এড়ানোর জন্য ভিটামিন 'কে' (১ গ্রাম খাদ্যপ্রাণ ৫০ লিটার পানি মিশিয়ে) সপ্তাহে ১ দিন খাওয়াতে হবে। এছাড়া মুরগিকে ভিটামিন 'বি' ও ভিটামিন 'বি' গ্রুপের অন্যান্যগুলো যেমন- রিবোফ্লাবিন, নায়াসিন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দিতে হবে।

লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালন:

মুরগির প্রজাতি, পালে মুরগির সংখ্যা ও পালন পদ্ধতির ওপর ঘরের আয়তন নির্ভর করে। ব্যবসায়ভিত্তিক মুরগি খামারে ১০০০টি ডিম পাড়া মুরগির জন্য প্রতি পালে ১২৫টি করে মোরগ রাখা ভালো। এজন্য বড় করে ২০ ফুট অন্তর অন্তর প্রাচীর দিয়ে খোপ করতে হয়।

এ পদ্ধতিতে মুরগি পালনে ঘরের মেঝেতে লিটার ব্যবহার করা হয়। মুরগির বিছানা হিসেবে ব্যবহৃত বস্তুসমূহকে লিটার বলা হয়। যেমন- ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, টুকরা করে কাটা খড়, আখের ছোবড়া, চীনাবাদামের খোসা ইত্যাদি।

আবদ্ধ ঘরের মধ্যে মুরগির স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য, বেশি ডিম উৎপাদনের জন্য, আলো বাতাস ও তাপমাত্রা ঠিক রেখে আরামপ্রদ পরিবেশ তৈরির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। যার মধ্যে লিটার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবদ্ধ ঘরের মেঝেতে মুরগি পালন করতে দু'টি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যথা- (১) লিটার ও (২) ডিপ লিটার পদ্ধতি।

লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে লিটারের ঘরের বৈশিষ্ট্য হবে নিম্নরূপ-

  1. ঘরের মেঝে স্যাঁতসেঁতে না হয়ে শুষ্ক হতে হবে।
  2. ঘরের ভিত জমি সমতল হতে অন্তত ১-২ ফুট উঁচু হতে হবে।
  3. ঘরে আলো-বাতাস চলাচলের উপযোগী জানালা থাকতে হবে। ঐ জানালা দিয়ে রোদ আসার ব্যবস্থা থাকলে তা হবে উত্তম।
  4. জানালায় তারের জালি দিয়ে তার সাথে চটের পর্দা দেওয়া ভালো। কোনোক্রমেই কাঁচের জানালা করা উচিত নয়। তাতে মুরগির স্বাস্থ্য হানি হতে পারে।
  5. ঘরের একপাশে ড্রেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে ঘরের মেঝের বিছানা উল্টে দিয়ে ধুয়ে পানি ফেলতে সুবিধা হবে। এমনকি খাবার পানির পাত্রটি ড্রেনের কাছে রাখলে পাত্র উল্টে পড়লে মুরগির বিছানা ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
  6. ঘরের ড্রেন খোলা রাখা উচিত নয়। কারণ ঐ ফাঁক দিয়ে সাপ, বেজি, ইঁদুর ঘরে ঢুকে খাবার নষ্ট করতে পারে, মুরগির ক্ষতি করতে পারে।
  7. ঘরের চৌকাঠ ১০-১২ ইঞ্চি উঁচু করতে হয়। কারণ মেঝেতে লিটার বিছানোর ফলে উঁচু হয়ে যাতে মুরগি বের হয়ে না আসতে পারে।
  8. দরজা ৪ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট চওড়া হলে সহজে যাতায়াত ও ব্যবস্থাপনা করা যায়।
  9. দরজার কাছে কাঠের/বাঁশের ধাপ থাকলে ভালো হয়। এতে মুরগির যাতায়াত নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হয়।

লিটারের বৈশিষ্ট্য:

  1. ওজনে হাল্কা হতে হবে এবং জলীয় অংশ অত্যন্ত কম থাকবে।
  2. লিটার দ্রব্যাদি মিহি গুঁড়া বা বড় বড় টুকরার ন্যায় হবে না।
  3. মুরগির বিষ্ঠার জলীয় অংশ সহজে শোষণ করার ক্ষমতা বেশি থাকতে হবে। কোনো কারণে ভিজে গেলে তাড়াতাড়ি শুকানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। লিটারের আর্দ্রতা কখনো ২০% এর বেশি হবে না।
  4. নরম ও আরামদায়ক হতে হবে। সহজে বাতাস থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ করবে না।
  5. স্বল্প তাপবাহী হতে হবে। অর্থাৎ তাপ ধারণ ক্ষমতা কম থাকতে হবে।
  6. উপকরণের সহজলভ্যতা ও কম মূল্যের হতে হবে।

মুরগির ঘরে লিটার (পশুপাখির বিছানা) ব্যবহার করার ফলে মেঝেতে মুরগির বিষ্ঠা লেপ্টে মেখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে না, পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয় না এবং ঘর পরিষ্কার করা সহজ হয়। সাধারণত ঘরের মেঝেতে ২.৫-৫.০ সে. মি. পুরু করে এ বিছানা তৈরি করা হয়। মুরগির বিষ্ঠা এতে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। বড় বড় খামারে এ পদ্ধতিতে মুরগি পালন করা হয়।

ডিপ লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালন ইংরেজি শব্দ ডিপ (Deep) এর অর্থ গভীর বা পুরু করে লিটার মুরগি পালনে ঘরের মেঝেতে ব্যবহার করাকে ডিপ লিটার বলা হয়। লিটার অবশ্যই শুকনা হতে হবে। কেননা ভিজা থাকলে ছত্রাক ও রোগজীবাণু সৃষ্টি হবে। যেমন- সালমোনেলেসিস, ককসিডিয়া ইত্যাদি। ঘরে মুরগি দেওয়ার ২-৩ দিন আগে লিটার বিছাতে হয়।

ডিপ লিটারে গরমের সময় ৫-৬ ইঞ্চি এবং বর্ষার সময় ৮-১০ ইঞ্চি পুরু করে লিটার বিছানো উচিত। কিছু কিছু করে লিটার ছিটিয়ে দিতে দিতে বছরে প্রায় ১ ফুট পর্যন্ত পুরু হতে পারে। যে অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত (৫০ ইঞ্চির ঊর্ধ্বে) সেখানে সাধারণত মার্চ-এপ্রিল অথবা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে লিটার ব্যবহার করা ভালো। আর খামারের পুরানো মুরগি পাল্টানোর সময় সমস্ত লিটার পরিবর্তন করতে হয়।

ডিপ লিটারে করণীয় কাজ ও পরিচর্যা:

  1. মুরগি দিবা-রাত্রি মল ত্যাগ করে, কাজেই গ্যাস হওয়া স্বাভাবিক। তাই সপ্তাহে একবার একদিক চোখা কাঠি/লাঠি দিয়ে লিটার খুঁচিয়ে ওলটপালট করে দেওয়া উচিত। তাতে মুরগির মল লিটারে মিশে যাবে এবং নিচের দিকে চলে যাবে, ফলে মুরগি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। কেননা অ্যামোনিয়া গ্যাসের কারণে বিভিন্ন শ্বাস রোগ; যেমন- অ্যাসপারজিলোসিস, ইনফেকসাস কোরাইজা, মাইকোপ্লাজমোসিস ইত্যাদি হতে পারে।
  2. মুরগির ঘরের বিছানা এক বছর পর্যন্ত রাখা চলে। তারপর ৭৫% বিছানা ফেলে দিয়ে ২৫% রেখে তা নতুন বিছানার সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
  3. মুরগির ঘরের লিটার পাল্টাবার সময় মেঝে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে তারপর চুন ছিটিয়ে দিতে হয়। আর বিছানা পাতার আগে মেঝে ফিনাইল/লাইজল/ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুয়ে নেওয়া সবচেয়ে ভালো।
  4. বিছানা ভিজে গেলে সাথে সাথে পাল্টানো ভালো। অথবা চুন ছিটিয়ে দিলেও চলে।
  5. ঝাঁকের মুরগি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো মুরগির রোগ বা অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে সাথে সাথে সরিয়ে ফেলতে হবে। কোনো কোনো সময় সমস্ত বিছানা পাল্টানোর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
  6. ঘরে উকুন বা পোকা মাকড় দেখা দিলে গ্যামাক্সিন ব্যবহার করা ভালো।
  7. বর্ষা এবং শীতকালে বিছানা ৮ ইঞ্চি পুরু থাকা ভালো। আর ঘরে শীতে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ এবং বর্ষায় বৃষ্টির ঝাপটা ঢোকা সম্বন্ধে সর্তক থাকতে হবে। অন্যদিকে ঘরে রোদ ও বাতাস চলাচলে কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।
  8. প্রতিটি মুরগির জন্য গড়ে ৫ বর্গফুট জায়গা লিটার ঘরে থাকা উচিত।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। মুরগির বিভিন্ন পালন পদ্ধতি | মুক্ত পালন পদ্ধতির অসুবিধাসমূহ এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url