পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব।
পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক (Relationship of Civics & Good Governance with Sociology), সমাজবিজ্ঞান সমাজবদ্ধ মানুষের সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপ এবং সামাজিক জীবনের আলোচনা, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করে। সমাজবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য হলো সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ও সংহতি বজায় রাখার নীতিমালা নির্ধারণ করা।
উইলিয়াম পি স্কট (William P.Scott) তার Dictionary of Sociology গ্রন্থে বলেন, 'সমাজবিজ্ঞান হলো মানুষের সামাজিক আচরণের বিজ্ঞানভিত্তিক অধ্যয়ন।' সমাজবিজ্ঞান মানুষের জীবনের সূচনা, সংগঠন, ক্রমবিকাশ ও পরিণতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করে। এজন্য সমাজবিজ্ঞানকে 'মৌলিক সামাজিক বিজ্ঞান' বলা হয়।
অপরদিকে, পৌরনীতি ও সুশাসন সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আচরণ, তার কার্যাবলি এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অনুধাবন করে অনেকের অভিমত হলো, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানীকে একাধারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী হতে হবে।
আর তাই উইলসন (Wilson) তাঁর 'Elements of Modern Politics' গ্রন্থে বলেন, 'It must be admitted, of course, that it is often difficult to determine, whether a particular writer should be considered as sociologist, political theorist or Philosopher,' উভয় শাস্ত্রের সম্পর্ক বর্ণনা করতে গিয়ে ফরাসি দার্শনিক পল জ্যানেট (Paul Janet) বলেন, 'সমাজবিজ্ঞানের যে অংশটি রাষ্ট্রের মূলভিত্তি এবং সরকারের নীতিসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান।' (Political science is that part of social science which treats of the foundations of the state and principles of government.) এ কারণেই পৌরনীতি ও সুশাসন এবং সমাজবিজ্ঞান গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
ক. পৌরনীতি ও সুশাসন এবং সমাজবিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক। পৌরনীতি ও সুশাসন রাষ্ট্র ও নাগরিকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন সংগঠন সম্পর্কে আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। অপরদিকে, সমাজবিজ্ঞান সমাজের উৎপত্তি, বিকাশ, মূল্যবোধ, সামাজিক পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে পৌরনীতি ও সুশাসনের অধ্যয়নকে সমৃদ্ধ করে। পৌরনীতি ও সুশাসন মানুষকে রাজনৈতিক জীব হিসেবে কল্পনা করে। আর মানুষ কীভাবে এবং কেন রাজনৈতিক জীব, সমাজবিজ্ঞানে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাই বলা যায়, পৌরনীতি ও সুশাসন এবং সমাজবিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক।
খ. সমাজবিজ্ঞান সমাজকে সাধারণভাবে পর্যালোচনা করে। আর পৌরনীতি ও সুশাসন মূলত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে মানুষের কার্যাবলি পর্যালোচনা করে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি এবং কার্যাবলি পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচ্য বিষয়। পক্ষান্তরে, সমাজের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, বিবর্তন ইত্যাদি সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। আলোচনার পরিধির দিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, পৌরনীতি ও সুশাসন সমাজবিজ্ঞানের অংশবিশেষ।
অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানকে যদি একটি বৃক্ষ বলে মনে করা হয় তাহলে পৌরনীতি ও সুশাসনকে ওই বৃক্ষের একটি শাখা বলা চলে। সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে প্যাসকুয়াল গিসবার্ট (P. Gisbert) তাঁর 'Fundamentals of Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, 'সমাজবিজ্ঞানের মূলনীতিগুলো যে শিক্ষা করেনি তাকে রাষ্ট্র সম্পকীয় মতবাদ শিক্ষা দেওয়া, নিউটনের গতিসম্পর্কীয় সূত্র যে শিক্ষা করেনি তাকে জ্যোতির্বিদ্যা বা তাপ প্রয়োগ দ্বারা যন্ত্র চালনাবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার সমান।' (To teach the theory of the state to men who have not learnt the first principles of sociology is like teaching Astronomy of Thermodynamics to men who have not learnt the Newtonian laws of motion.)
গ. সামাজিক কল্যাণের জন্য সমাজে বিদ্যমান প্রথা, রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি কোনো রাষ্ট্রই উপেক্ষা করতে পারে না। এসব বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানীরাও গবেষণা করেন।
ঘ. পৌরনীতি ও সুশাসন মূলত নাগরিকতা সম্পর্কিত বিজ্ঞান। তবে নাগরিকতার ধারণা, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক এ বিষয়গুলো পৌরনীতি ও সুশাসন এবং সমাজবিজ্ঞান উভয়েরই আলোচ্য বিষয়। সমাজবিজ্ঞানের পরিধি অবশ্য পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি অপেক্ষা বৃহত্তর। পৌরনীতি ও সুশাসনকে সমাজবিজ্ঞানের অংশরূপে বর্ণনা করা গেলেও উভয় বিজ্ঞানই পরস্পর নির্ভরশীল। সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্র এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসনকে তথ্য সরবরাহ করে। অনুরূপভাবে পৌরনীতি ও সুশাসন সমাজবিজ্ঞানকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যোগায়।
পৌরনীতি ও সুশাসন এবং সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এদের মধ্যে কিছু পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। সমাজবিজ্ঞান মানবীয় বিজ্ঞানগুলির মধ্যে একটি মৌলিক বিজ্ঞান। পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি, রাষ্ট্র, মানবজাতির আচার- ব্যবহার, রীতিনীতি এবং সংগঠিত ও অসংগঠিত সব সম্প্রদায় প্রভৃতি নিয়ে সমাজবিজ্ঞান আলোচনা করে।
কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে কেবলমাত্র রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত সমাজ ও তাদের কার্যাবলি নিয়ে। এ প্রসঙ্গে গিলক্রিস্ট (R. N. Gilchrist)-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। 'Principles of Political Science' শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন: 'Sociology studies man as a social being and as political organisation is a special kind of social organisation; Political science is a more specialised science than Sociology.
নাগরিক জীবনের অধিকার ও কর্তব্য হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান বিষয়বস্তু। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার সূচনা হয় সমাজজীবনের গোড়াপত্তনের শুরু থেকেই। সমাজের সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্র সৃষ্টির বহু আগে। মানুষের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, পরিবার প্রভৃতি সম্পর্কে যে সব আচার-পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তা রাষ্ট্র সৃষ্টির বহু আগেই সৃষ্টি হয়েছে। এসব রীতিনীতি, প্রথা, নিয়ম-কানুন রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্টি হয়নি।
মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হওয়ার অনেক আগেই সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সমাজ রাষ্ট্র অপেক্ষা প্রাচীন সংগঠন। এ কারণেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি সমাজবিজ্ঞানের তুলনায় ক্ষুদ্র ও সীমিত। তবে এ কথা সত্যি যে, শাস্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞান অপেক্ষা অনেক প্রাচীন।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সুসংবদ্ধ আলোচনা আরম্ভ হয়। অপরপক্ষে সমাজবিজ্ঞানের শৃঙ্খলাবদ্ধ আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্রই উনবিংশ শতাব্দী থেকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ধরে নেয় যে, মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতন এবং নিজের অধিকার আদায়ে সক্ষম।
কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় সংগঠিত- অসংগঠিত, সচেতন-অসচেতন সব শ্রেণীর জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত। অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সহদেব বলেছেন: 'Sociology is the study of both organised and unorganised communities. Political Science deals with organised communities only.' এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক গার্ণার (J. W. Garner)-এর অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। 'Political Science and Government' শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন: 'Political Science is concerned with only one form of human association the state: Sociology deals with all forms of association.' এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা দরকার যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানুষের কেবলমাত্র সচেতন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। অপরদিকে সমাজবিজ্ঞানে সমাজবদ্ধ মানুষের সচেতন-অচেতন নির্বিশেষে সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনুশীলন করা হয়। অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সহদেব মন্তব্য করেছেন: 'Unlike Political Science which treats only conscious activities of man, Sociology treats unconscious activities of man also.
সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে উপযোগিতাগত পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। অনেকের অভিমত অনুসারে সমাজবিজ্ঞানের আলোচনা হল মূলতঃ তাত্ত্বিক। অপরপক্ষে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা হলো বহুলাংশে ব্যবহারিক। এই কারণে অনেকে উপযোগিতার বিচারে সমাজবিজ্ঞানকে একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান এবং বিপরীতক্রমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেন।
তাছাড়া অনেকে আবার সমাজবিজ্ঞানকে 'বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান' (Positive Science) এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে 'আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান' (Normative Science) হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকের অভিমত অনুসারে সমাজবিজ্ঞানে তত্ত্বের আলোচনাকে মূল্যমানের আলোচনা থেকে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র করা সম্ভব নয়।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্র একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। সমাজ ছাড়া যেমন রাষ্ট্রের সৃষ্টি সম্ভব নয়, তেমনি রাষ্ট্র ছাড়া সমাজ অসম্পূর্ণ। তাই পৌরনীতি ও সুশাসন এবং সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও এদুটি শান্ত একে অপরের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। তাই উভয়ের মধ্যে চূড়ান্ত সীমারেখা টানা যায় না।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে সমাজবিজ্ঞানের সম্পর্ক এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url