ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করব।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা (Economic, Social & Political Conditions of Bengal under East India Company). ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলা তথা ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ছিল নিম্নরূপ:

অর্থনৈতিক অবস্থা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিয় শোষণ, নির্যাতন, কুশাসন, লুন্ঠন প্রভৃতির ফলে ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসনামলে 'একসালা' ও 'পাঁচসালা' বন্দোবস্তের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়া রাজস্ব আদায়কারী ঠিকাদারদের অত্যাচারে বাংলার জনগণের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে পড়ে।

লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে ১৭৯৩ সালে 'চিরস্থায়ী বন্দোবন্ত' ঘোষিত হলে জমির উপর মালিকানা এমনকি হস্তান্তর, পত্তন ও ইজারা দেওয়ার ক্ষমতাও জমিদাররা লাভ করেন। এর ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়া ও দালালি করে যারা নগদ অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন তারাই জমিদারি ক্রয় করে নতুন জমিদার হন।

এসব নব্য জমিদারদের সময় ভূমি রাজস্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। পূর্বের অধিকাংশ মুসলমান জমিদার তাদের জমিদারি হারান। মুসলমানরা লাখেরাজ ও ওয়াকফ সম্পত্তি ভোগের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। এর ফলে বাংলার কৃষক সমাজ বিশেষ করে মুসলমান কৃষক সমাজ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। শিল্প বিপ্লবের পর ব্রিটেনে বড় বড় শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠে। এসব শিল্প-কলকারখানার কাঁচামাল যেত ভারতবর্ষ থেকে।

বিনিময়ে ব্রিটেনে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ভারতে আসতো। এর ফলে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। এসব কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট তত্ত্ববায় ও কারিগরগোষ্ঠী ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবেই ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের বিশেষ করে বাংলার কৃষক সমাজ অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু, রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

সামাজিক অবস্থা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দু জনগণের মধ্যে বীরে ধীরে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটলেও মুসলমানরা দীর্ঘদিন এক্ষেত্রে ছিল পিছিয়ে। মুসলমানরা ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষালাভ থেকে বিরত থাকায় সামাজিক দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ে।

এজন্য ব্রিটিশ শাসননীতি যেমন দায়ী ছিল, তেমনি একশ্রেণির গোঁড়া মুসলমানের প্রচার-প্ররোচনাও দায়ী ছিল। লাখেরাজ সম্পত্তি এবং ১৭৯৮ সালে 'পল্লি পুলিশ ব্যবস্থা' বিলুপ্ত করার ফলে এবং সবশেষে ১৮৩৭ সালে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষারূপে প্রচলনের ঘোষণা প্রদানের ফলে এদেশের মুসলমান জনগণ চাকরি ও অন্যান্য সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি হারান।

হিন্দু-মুসলমানের অসম বিকাশ: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হয় তারা প্রায় সকলেই ছিলেন হিন্দু। ধীরে ধীরে হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষালাভ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। রাজা রামমোহন রায়ের প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অগ্রহ এবং রাধাকান্ত দেবের শিক্ষা অনুরাগ একটি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।

বাংলায় নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও উদারনৈতিক চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তীতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের চেষ্টায় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত জনগণ শিক্ষা-দীক্ষায় আরো অগ্রসর হন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু জনগণ ১৮৪৩ সালে Bengal British India Society গঠন করেন।

এ সমিতির উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংগঠিত করা এবং ভারতীয়দের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। ১৮৫১ সালে British India Association, ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং আনন্দমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় Indian Association এবং ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বোম্বাই শহরে "সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের" জন্ম হয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতীয় জনগণ বিশেষ করে শিক্ষিত হিন্দু জনগণ নিজেদেরকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।

অপরদিকে, ১৭৫৭ সালের পর থেকে মুসলমান জনগণের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। হিন্দু জনগণ যেভাবে ব্রিটিশ শাসনকে মেনে নিতে পেরেছিল মুসলমানরা তা পারেনি। মুসলমানরা দীর্ঘদিন সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাবার স্বপ্নে বিভোর ছিল। ফলে ব্রিটিশ সরকারও তাদেরকে সুনজরে দেখেনি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমান জমিদারদের প্রায় সকলেই তাদের জমিদারি হারান। একশ্রেণির মুসলমানের প্রচার-প্ররোচনার ফলে মুসলমান জনগণ ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে বিরত থাকে।

হিন্দু সমাজে যেমন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মুক্তবুদ্ধির অধিকারী সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটেছিল মুসলমান সমাজে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে সেরূপ মনীষীর আগমন ঘটেনি। ফলে মুসলমান সমাজ রক্ষণশীলতা ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে পারেনি। বরং সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভী, তিতুমীরের মতো মুসলমান নেতাগণ সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের

বিপ্লব ব্যর্থ হয় এবং ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের প্রতি আরো বৈরী আচরণ শুরু করে। ১৮৫৮ সালের পর থেকে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ, আমীর আলী প্রমুখের চেষ্টায় মুসলমান জনগণও ব্রিটিশ বিরোধিতার পুরনো নীতি-কৌশল পরিত্যাগ করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর ফলে মুসলমান জনগণের মধ্যেও ধীরে ধীরে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে।

ভাগ কর ও শাসন কর নীতি (Divide and Rule Policy): ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য প্রথম থেকেই 'ভাগ কর ও শাসন কর নীতি' কার্যকরী করার চেষ্টা চালায়। মুসলমান জনগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোপ্তানির শাসনামলে তাদের নবাবি ও শাসন ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।

সুচতুর ইংরেজ শাসকগণ এ সময় হিন্দু জনগণকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত করে তুলতে থাকেন। ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, নতুন নতুন জমিদারি হিন্দুদের করায়ত্ত হতে থাকে। হিন্দু জনগণ ব্রিটিশদের অনুগত থেকে নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে সক্ষম হন। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীর প্রমুখের আন্দোলনের ফলে মুসলমান জনগণের প্রতি ব্রিটিশ শাসকগণ আরো সন্দিহান হয়ে পড়েন।

১৮৯২ সাল থেকে শুরু হয় হিন্দু পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন। এ সময় থেকে কংগ্রেসের হিন্দু জাতীয়তাবাদী চরমপন্থি নেতাদের কার্যকলাপে ব্রিটিশ সরকার সন্দিহান হয়ে পড়ে। সুচতুর ও সাবধানী ব্রিটিশ শাসকগণ এরপর মুসলমান জনগণকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের কৌশল বা নীতি গ্রহণ করে।

হিন্দু পুনর্জাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল কলিকাতাকে দুর্বল করার জন্যই ব্রিটিশ শাসকগণ বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অপরদিকে ১৮৫৮ সালের পর থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় মুসলমান জনগণ ইংরেজি ভাষা, পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষালাভে সচেষ্ট হয় এবং ধীরে ধীরে তাদের উপর থেকে ব্রিটিশ বিদ্বেষ হ্রাস পেতে থাকে।

তারপর যতবারই হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, ততবারই ব্রিটিশ সরকার 'ভাগ কর ও শাসন কর' নীতি বা কৌশল (Divide and Rule Policy) প্রয়োগ করে হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য ও সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে এবং তাকে জীবিত রেখেই প্রায় দু'শ বছর ভারতবর্ষে তাদের। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ চালাতে সক্ষম হয়েছিল।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url