পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি বা বিষয়বস্তু
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি বা বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব।
একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের জন্য পৌরনীতি ও সুশাসন অপরিহার্য। পৌরনীতি আমাদের নাগরিক হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে ধারণা দেয়, এবং সুশাসন নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার নীতির উপর ভিত্তি করে।
পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিভিন্ন সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে মানুষ যে সব কাজ করে তার সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। এটি প্রধানত রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে মানুষের কার্যাবলি পর্যালোচনা করে। আর মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলি বিশ্লেষণ করাই পৌরনীতি ও সুশাসনের মূল পরিধি বা বিষয়বস্তু। পৌরনীতি ও সুশাসনের মূল পরিধি বা বিষয়গুলোকে নিচের চিত্রের সাহায্যে দেখানো যায়-
পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি বা বিষয়বস্তু কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, আরও বহুবিধ বিষয় এ শাস্ত্রে আলোচিত হয়। অর্থাৎ, নাগরিকের জীবন ও কার্যাবলি যতদূর বিস্তৃত এবং যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে, পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ততদূর প্রসারিত। আবার মানুষের জীবনের বর্তমান সমস্যার সাথে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বিষয় বা জটিলতা। এগুলো প্রায় সবই পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে সম্পর্কিত। তাই বিষয়টির পরিধি দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো-
ক. নাগরিকতা ও সমাজজীবন: নাগরিকতা এবং সমাজজীবন পৌরনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির পদমর্যাদাই হচ্ছে নাগরিকতা। আর পৌরনীতি ও সুশাসন হচ্ছে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। নাগরিকতার সাথে জড়িত সব বিষয় (নাগরিকতার উদ্ভব, বিকাশ, বিবর্তন; সুনাগরিকতা, সুনাগরিকতার গুণাবলি; নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি) নিয়ে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে। আবার একজন ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রের সদস্যই নয় বরং একই সাথে সে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও সদস্য হতে পারে।
খ. মৌলিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত: পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন মৌলিক প্রতিষ্ঠান নিয়েও আলোচনা করে। কেননা সমাজের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্র বিকশিত হয়। সমাজের সবচেয়ে আদি প্রতিষ্ঠান 'পরিবার' নিয়ে পৌরনীতি ও সুশাসন গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করে। আবার সমাজ, সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক মূল্যবোধ; রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ, রাষ্ট্রের কার্যাবলি; জাতি, গোত্র, সম্প্রদায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র প্রভৃতি মৌলিক প্রতিষ্ঠান এর পরিধির মধ্যে পড়ে।
গ. নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পর্যালোচনা: পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকের বর্তমান অবস্থা, অধিকার এবং কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি নাগরিকের অতীত এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করে। কীভাবে নাগরিকতার ধারণার উদয় হয়েছিল; কীভাবে এ ধারণাটি যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে; কীভাবে রাষ্ট্রের ধারণা ও কার্যাবলি এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা যুগে যুগে বিকশিত ও পরিবর্তিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেই বা নাগরিকতা ও রাষ্ট্রের ধারণা, ধরন ও কার্যাবলি কেমন হতে পারে সে আলোচনাও পৌরনীতি ও সুশাসনের অন্তর্ভুক্ত।
ঘ. নাগরিকতার সাথে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনা: পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোকপাত করে। আবার স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিকতার ব্যাখ্যাও প্রদান করে। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতার স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে দিকগুলো পর্যালোচনা করে সেগুলো হলো-
১. মানুষ কোনো না কোনো সংস্থার সদস্য: একজন নাগরিক তার পরিবার, গ্রাম, ইউনিয়ন কাউন্সিল বা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতি) সদস্য। এ সব প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে একজন নাগরিক যে সব কাজ সম্পাদন করে তা নাগরিকতার স্থানীয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
২. প্রত্যেক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের নাগরিক: প্রত্যেক ব্যক্তিই কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য প্রকাশ, সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা, নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এ সবকিছুই নাগরিকতার জাতীয় দিকের অন্তর্ভুক্ত। আবার নাগরিকতা সম্পর্কিত জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন- আইনসভা, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র প্রভৃতি নিয়ে পৌরনীতি ও সুশাসন বিস্তারিত আলোচনা করে।
৩ . প্রত্যেক ব্যক্তিই বিশ্ব নাগরিক: রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে একজন নাগরিক বিশ্ব সমাজেরও সদস্য। আধুনিক যুগে নাগরিকের ভূমিকা স্থানীয় ও জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। তাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নাগরিকের ভূমিকা কী হতে পারে তাও পৌরনীতি ও সুশাসনে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক যখন বিশ্বসমাজের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার অধিকার ভোগ করে এবং বিনিময়ে বিশ্বসমাজের অপর নাগরিকের প্রতি কর্তব্য পালনে আগ্রহী হয়, তখন নাগরিকতা আন্তর্জাতিক রূপ পায়। সুতরাং, নাগরিকের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক (জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি প্রভৃতি) ও আঞ্চলিক সংস্থার (সার্ক, আরব লীগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রভৃতি) উদ্ভব, বিকাশ, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধির আওতাভুক্ত।
ঙ. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনা: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহও পৌরনীতি ও সুশাসনের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও উৎপত্তির ইতিহাস; রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ (জনগণ, সরকার, সার্বভৌমত্ব, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড); সংবিধানের প্রকৃতি ও শ্রেণিবিভাগ; সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ বা বিভাগের প্রকৃতি; নির্বাচন ও নির্বাচকমণ্ডলী: রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ; জনমত ইত্যাদি পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধিভুক্ত।
চ. বিমূর্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের আলোচনা: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি পৌরনীতি ও সুশাসন বিমূর্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করে। আইনের ধারণা, প্রকৃতি, উৎস, প্রয়োজনীয়তা; নৈতিকতার ধারণা; আইনের সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক; স্বাধীনতার ধারণা, প্রকৃতি, প্রকারভেদ, রক্ষাকবচ; আইনের সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক ইত্যাদি বিমূর্ত বিষয়গুলো পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচনার পরিধিভুক্ত।
ছ. নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা: পৌরনীতি ও সুশাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা। নাগরিকের উত্তম জীবন নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। উত্তম নাগরিক জীবন গঠনের উদ্দেশ্যে পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করে। কীভাবে যথাযথভাবে নাগরিকের অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালন করা যায় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পৌরনীতি ও সুশাসনের অন্তর্ভুক্ত।
জ. সাংবিধানিক অগ্রগতি সম্পর্কিত আলোচনা: পৌরনীতি ও সুশাসন সাংবিধানিক বিকাশ ও অগ্রগতির ধারা নিয়েও আলোচনা করে থাকে। এ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলের সাংবিধানিক বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংবিধানের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সময়ে আনা সংশোধনীসমূহ, জাতীয় সংসদের নির্বাচনসমূহের ফলাফল এবং বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালনকারী সরকারের মন্ত্রিসভার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধান, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান ইত্যাদি পৌরনীতি ও সুশাসনে আলোচনা করা হয়েছে।
ঝ. রাজনৈতিক ঘটনাবলি: প্রতিটি রাষ্ট্রেই রাজনীতিকে কেন্দ্র করে কিছু না কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়। নাগরিক জীবনে ঘটে যাওয়া এসব রাজনৈতিক ঘটনা ও এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে পৌরনীতি ও সুশাসন। যেমন- ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ ও ১৯১১ সালে যথাক্রমে বঙ্গভজা প্রস্তাব ও তা রদ, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের আগরতলা মামলা ও গণ-অভ্যুত্থান, পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচ্য বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত। ওপরের আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, নাগরিক জীবনের যেসব দিক কোনো না কোনোভাবে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত সেগুলোই পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি বা বিষয়বস্তু।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি বা বিষয়বস্তু এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url