নাইলোটিকা মাছ চাষ পদ্ধতি
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে নাইলোটিকা মাছ চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
নাইলোটিকা মাছ চাষ পদ্ধতি (Methods of Nilotika fish culture) ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড থেকে নাইলোটিকা মাছ আমদানি করা হয়। মাছটি দ্রুত বর্ধনশীল ও সারা বছরই চাষ করা যায়। বছরে ৩-৪ বার ডিম পাড়ে। ৩ মাস বয়সে প্রজননক্ষম হয় এবং ২ মাস বয়সে খাওয়ার উপযোগী হয়। যে জলাশয়ে বছরে ৫-৬ মাস পানি থাকে সেখানেও অনায়াসে নাইালোটিকা মাছ চাষ করা যায়।
নাইলোটিকা মাছের বৈশিষ্ট্য:
- এটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল মাছ।
- নাইলোটিকা ও লাল তেলাপিয়ার মধ্যে গিফট জাতের উৎপাদনশীলতা গড়ে ৫০ ভাগ বেশি।
- তুলনামূলকভাবে কম খরচে ও সহজ ব্যবস্থাপনায় ৩/৪ ফুট পানির গভীরতায় এটি চাষ করা যায়।
- যেকোনো খাবার এরা পছন্দ করে এবং ৫ মাসে ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের হতে পারে।
- সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
- অতি সহজে পোনা উৎপাদন করা যায়। মিশ্রভাবে ভেটকি, মাগুর বা শিং মাছের সাথে চাষ করা যায়।
- খেতে সুস্বাদু এবং বাজারে চাহিদা বেশি।
- অন্তঃপেশি কাঁটা নাই বলে ছোটদের জন্যও উপযোগী।
পুকুর নির্বাচন: ৪-৫ মাস পানি থাকে এমন পুকুরও নির্বাচন করা যায়। তবে সারা বছর পানি থাকে বা মৌসুমি উভয় ধরনের পুকুরই এ মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা যায়। নিচে নাইলোটিকা মাছের চাষ পদ্ধতি এবং বাস্তবায়ন পঞ্জিকা দেওয়া হলো:
পুকুরের আকার: পুকুরের আকার কয়েক শতাংশ হতে এক একর পর্যন্ত হতে পারে। তবে এক বিঘা হতে দুই বিঘার ভিতর হওয়াই ভালো। আবার ১০-২০ শতাংশ হলে ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পুকুরের আকৃতি: পুকুরের আকৃতি আয়তাকার হলে মাছ ধরা হতে শুরু করে অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। তবে জমি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে অন্য আকৃতিরও হতে পারে।
পুকুর সংস্কার, পরিষ্কার করা ও রাক্ষুসে মাছ নিধন:
পুকুরের পাড়: পুকুরের পাড় এমন উঁচু করতে হবে যাতে বৃষ্টি বা বন্যার পানি পুকুরের ভিতর ঢুকতে না পাড়ে। পুকুরের পাড় প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ পুকুরের পাড় নানা কারণে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গে। দুই বিঘার একটি পুকুর পাড়ের মাথা কমপক্ষে ৪/৫ ফুট প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে পাড় যত প্রশস্ত হোক না কেন কয়েক বছর পর পর তা মেরামত করতে হয়।
পুকুরের ঢাল: পুকুরের পাড়ের ঢাল কমপক্ষে ২৪১ অনুপাতে হতে হবে। অথবা পুকুর পাড়ের ঢাল এমন হতে হবে যাতে করে সহজেই হেঁটে পুকুরের তলার পানির কাছে নামা যায়। নাইলোটিকা মাছ মাটি গর্ত করে বাসা তৈরি করে, সেজন্য খাড়া পাড় হলে ভাড়াতাড়ি ভাঙ্গে। তাই এই মাছের জন্য ঢালু পাড় করা উচিত।
পুকুরের মাটি: যেসব মাটি পানি ধরে রাখতে পারে সেসব মাটিতে পুকুর খনন করা উচিত। এঁটেল মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি এবং বেলে মাটির সবচেয়ে কম। বিল এলাকার মাটি সাধারণত এঁটেল প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে চর এলাকার মাটি বেলে প্রকৃতির হয়। তবে দোআঁশ মাটির পুকুরও ভালো হয়।
পুকুরের গভীরতা: পুকুর এমন গভীর হতে হবে, যাতে করে ৪-৫ ফুট বা, ১.২ মিটার পানি রাখা যায় তবে ১.৮ মিটারের বেশি নয়। যেসব ক্ষেত্রে গভীর নলকূপ হতে পুকুরে পানি সরবরাহ করা যায়, সেসব ক্ষেত্রে পাড়ের উচ্চতাসহ পুকুরের গভীরতা ৭-৮ ফুট হওয়া উচিত।
অন্যদিকে যেসব পুকুরে বাইরে থেকে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা নেই, সেসব ক্ষেত্রে পুকুরের গভীরতা এমন রাখতে হবে যাতে করে শুষ্ক মৌসুমে কমপক্ষে ৩ ফুট পানি থাকে। পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা: নিবিড় মৎস্য চাষে নিয়মিত পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের প্রয়োজন হয়। সেজন্য পুকুরে পানি প্রবেশের এবং নিষ্কাশনের জন্য নালা বা পাইপ রাখতে হয়। সরবরাহ পাইপ পাড়ের উপরের অংশে বসানোই ভালো।
অন্যদিকে নিষ্কাশন পাইপ উপরে-নিচে দু'অংশে রাখা প্রয়োজন। কারণ উপরের পাইপ দিয়ে পুকুরের পুরাতন দূষিত ও গরম পানি বেরিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে তলার পাইপ দ্বারা পানি বের করে পুকুর শুকানো যায়। উপরের ৩টি কাজের জন্য এক একরের একটি পুকুরে ৬ ইঞ্চি ব্যাসের ১টি পাইপ বসালেই চলে।
পুকুর প্রস্তুতিতে চুন প্রয়োগ: পুকুরের খনন কাজ সম্পন্ন হলে পোনা ছাড়ার আগে চুন প্রয়োগ করতে হয়। শুকনো বা পানি ভর্তি পুকুরেও চুন প্রয়োগ করা যায়। চুন পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হয়। প্রতি শতাংশে ১ কেজি করে চুন ব্যবহার করতে হয়।
সার প্রয়োগ: চুন প্রয়োগের ৭ দিন পর জৈব-অজৈব সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি শতাংশে ৩-৪ কেজি হারে গোবর, ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া, ৬৫ গ্রাম টিএসপি সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়। আর পুকুরে পানি থাকলে উক্ত পরিমাণ সার পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুর ছিটিয়ে দিতে হয়।
সার প্রয়োগের ৩ দিনের মধ্যেই পানির রং হালকা সবুজ হতে থাকে এবং এ সময় নাইলোটিকার পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। এরপরেও প্রাকৃতিক খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিলে প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি সার গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।
রাক্ষুসে মাছ নিধন। ম্যালাথিয়ন ইমালশন ২০: ১০ লক্ষ ভাগ পানি বা ১৬০ গ্রাম রোটেনন সামান্য পানিতে মিশিয়ে প্রতি শতাংশে পুকুরের পানিতে ছিটিয়ে দিলে ১ ঘণ্টা পর মাছ ও জলজ প্রাণী ভেসে উঠবে এবং মারা যাবে।
পানির তাপমাত্রা ও পুকুরের পানির পিএইচ: পোনা ছাড়ার সময় পানির তাপমাত্রা ২৬° ৩০° সে. এর ভিতর থাকতে হবে এবং পানির পিএইচ ৬-৯ এর ভিতরে রাখতে হবে। যদি কোন কারণে পানির পিএইচ কম থাকে তাহলে চুন প্রয়োগ করতে হবে। পানির তাপমাত্রা ৩০° সে. এর উপরে চলে গেলে গভীর নলকূপের পানি দিয়ে পুকুরের পানির তাপমাত্রা কমানো যেতে পারে।
পানির বিষাক্ততা: নর্দমার ময়লা, ময়লাযুক্ত পানি, শিল্প বর্জ্য, ট্যানারি বর্জ্য, অতিরিক্ত পলি প্রবাহ, কীটনাশক ও সার পানি দূষিত করে। এতে মাছের অসমোটিক চাপ বেড়ে যায়। খাদ্য শিকল নষ্ট হয়। এমতাবস্থায় চুন, পটাসিয়াম, পারম্যাঙ্গানেট প্রয়োগ করে পানির দূষণ ঠেকাতে হবে।
পুকুরে পোনা ছাড়া: পুকুরে চুন দেওয়ার ২৪ ঘন্টা বা তার কিছু পর পোনা ছাড়তে হবে। এর চেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত হলে অসুবিধা নেই। পোনা সকাল বেলা ছাড়াই ভালো। যদি পানি ঠান্ডা থাকে তাহলে যেকোনো সময় পোনা ছাড়া যায়। ছোট পোনা বৃষ্টির দিনে ছাড়তে নেই। বৃষ্টির পানিতে অক্সিজেন কম থাকে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড বেশি থাকে।
সেজন্য পোনা মারা যায়। রেণু পোনা ছাড়ার দিন বা তার পরের দিন ভারী বৃষ্টি হলে সব পোনা মারা যায়। বড় পোনার ক্ষেত্রে এ বিপদ এত প্রবল হয় না। পোনা মজুদের পরদিন থেকে মজুদকৃত পোনার দেহের ওজনের ৩-৪% হারে সকালে-বিকেলে খাবার পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হয়।
পোনার ঘনত্ব: পোনার ঘনত্ব বেশি হলে পোনার বৃদ্ধি কম হয়। তাই নাইলোটিকা চাষের জন্য খুব বেশি ঘনত্বে পোনা দিতে নেই। প্রতি শতাংশে ১৫০টি পোনা দেওয়া যায়। তাহলে ৫ মাসে মাছের গড় ওজন হবে প্রায় ৫০০ গ্রাম। অন্যদিকে ২০০টি পোনা দিলে ওজন হবে প্রায় ৩৫০ - ৪০০ গ্রাম। আর শতাংশে ৩০০টি পোনা দিলে ৫ মাসে প্রায় ৩০০ গ্রামের মতো ওজন হবে।
মাছের দেহ বৃদ্ধির পরীক্ষা: মাসে অন্তত একবার মাছের নমুনা সংগ্রহ করে বৃদ্ধির হার দেখতে হবে। কতদিনে কত গ্রাম ওজন বাড়ল তা দেখতে হবে এবং এই বৃদ্ধির জন্য কী পরিমাণ খাদ্য ব্যবহার করা হলো তাও দেখতে হবে। যদি কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধি না হয়, তার কারণ বের করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
যদি মাছের আকার এক রকম থাকে তাহলে অল্প মাছের ওজন নিলেই চলে। যদি মাছের আকার অসমান হয় তা হলে কয়েক হাজার মাছের ওজন নিতে হতে পারে। মাছের খাদ্য (প্রাকৃতিক ও সম্পূরক) প্রতিমাসে প্রতি বিঘা জলাশয়ে নিম্নোক্তভাবে সার দিয়ে যথেষ্ট প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়। যথা-
- ১ম সপ্তাহে: অজৈব সার ইউরিয়া ৩ কেজি ও টিএসপি ৩ কেজি।
- ২য় সপ্তাহে জৈব সার গোবর ১২০ ১৩০ কেজি।
- ৩য় সপ্তাহে: অজৈব সার ১ম সপ্তাহের সমপরিমাণ।
- ৪র্থ সপ্তাহে জৈব সার ২য় সপ্তাহের সমপরিমাণ।
পুকুরে সম্পূরক খাদ্য: মাছের ওজনের ৫- ৮% হারে দিনে ২ বার দিতে হয়। তবে তা হতে হবে চালের মিহি কুঁড়া ৫০- ৬০%, সরিষার খৈল ও মাছের গুঁড়া ৪০ - ৫০%, ক্ষুদিপানা ও সবুজ পাতা কুঁচি ১০%।
নাইলোটিকা মাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:
নাইলোটিকা মাছ অগভীর স্বাদু ও লবণাক্ত জলাশয়ে, অল্প পরিসরে, কম সম্পূরক খাদ্যে এবং কয়েক মাসে আহরনযোগ্য পর্যায়ে উৎপাদন করা যায়। নাইলোটিকা মাছ ৪-৫ মাসে বাজারজাত করা যায়। এ মাছের অন্তঃপেশী কাটা নেই বলে ছোট ও বয়স্কদের সবার জন্যই খাওয়ার সমস্যা হয় না।
এ মাছকে বাগদা চিংড়ি, ভেটকি ও রাজপুঁটির সাথে মিশ্রভাবে, এমনকি এককভাবেও চাষ করা যায়। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ৫ মাসে এক একটি মাছ ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। কখনো কখনো ৪-৪.৫ মাসেই বাজারজাত করার উপযোগী হয়। নাইলোটিকা মাছ ভাসমান খাঁচায় বা প্যানে চাষ করা যায়।
খাঁচায় প্রতি ঘনমিটারে ৩০-৪০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে যে সমস্ত নদী আছে সেখানে খাঁচায় নাইলোটিকা মাছ চাষ করে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। একই সাথে অনেক লোকের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়।
এমনকি নাইলোটিকা মাছ বৈদেশিক বাজারে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব। একটি ২০ ফুট × ১০ ফুট × ৬ ফুট সাইজের খাঁচায় এক ফসলে ৩৬০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়, যার বাজার মূল্য প্রায় ৩,৫০০ টাকা। এ মাছ বছরে দুইবার চাষ করে দ্বিগুণ টাকা আয় করা যেতে পারে।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। নাইলোটিকা মাছ চাষ পদ্ধতি এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url