উপকূলীয় এলাকায় এককভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ
আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে উপকূলীয় এলাকায় এককভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ নিয়ে আলোচনা করব।
উপকূলীয় এলাকায় এককভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ (Monoculture of Giant tiger prawn at Coastal Zone), বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাগদা চিংড়ি চাষের এলাকাসমূহ হচ্ছে- খুলনা ৩৪,১৫২ হে, সাতক্ষীরা ২৯,৪৭৯ হে, বাগেরহাট ৪২,৫২৬.২৮ হে, যশোর ৬৯০ হে., নোয়াখালী ৬১ হে., কক্সবাজার ২৭,০৬৯ হে., এবং চট্টগ্রাম ৩৮৩ হে তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ এলাকা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
নিচে এককভাবে বাগদা চিংড়ি চাষের পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হলো।
১. সাবেক পদ্ধতি: উপকূলীয় এলাকায় নিচু জমিতে উঁচু করে বাঁধ দিয়ে চিংড়ি ঘের তৈরি করা হয়। এ ঘেরে পানি প্রবেশের জন্য সুইস গেট তৈরি করা হয়। মরা কাটালের সময় জোয়ারের পানির উচ্চতা কম থাকে বলে এ সময় ঘেরে পানি ঢুকে না।
এর ফলে কয়েক দিন পানি আটকা থাকায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়। তাই ভরা কাটালের সময় লুইস গেট খুলে দিলে জোয়ারের পানির সাথে মিশে পানির গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং ভাটার সময় পানি নিকাশ করা যায়। ঘেরে জোয়ারের পানির সাথে কিশোর ও বড় বড় চিংড়ি প্রবেশ করে থাকে।
ব্লুইস গেট দিয়ে উপকূলীয় এলাকায় ঘেরের পানি নিয়ন্ত্রণ করে চিংড়ি চাষ করার জন্য পোনা ছাড়া হয় না এবং খাদ্যও সরবরাহ করা হয় না। ভরা কাটালে তুইস গেট দিয়ে পানি প্রবেশ করানোর সময় ভিতর হতে চিংড়িগুলো নতুন পানির দিকে সাঁতার কেটে যেতে থাকে। তখন ঝাঁকি জাল, রীক বা চাঁই বসিয়ে বড় বড় চিংড়ি ধরা হয়।
২. উন্নত পদ্ধতি: উপকূলীয় এলাকায় ঘেরে তলার মাটি একেবারে সমান করা উচিত নয়। ঘের পরিষ্কার করে শুকিয়ে অপদ্রব্য অপসারণ করাসহ কাঁকড়া, কুইচ্যা, সাপের গর্তে কীটনাশক দিয়ে সেগুলো মেরে ফেলতে হয়। মাটির পিএইচ কিছুটা অম্লীয় ও ক্ষারীয় অবস্থার মধ্যে রাখতে চুন, খৈল এবং গোবর দিতে হয়।
উপকূলীয় ঘেরে পানি প্রবেশ ও বের হওয়া নিয়ন্ত্রণে কাঠের ব্লুইস গেট তৈরি করা হয়। যেরে আগাছা, ঝোপঝাড় ও জলজ উদ্ভিদ যেন না থাকে তার ব্যবস্থা করতে হয়। জোয়ারের পানি ঘেরে প্রবেশের সময় বাগদার পোনা প্রবেশের সাথে রাক্ষুসে মাছের পোনা যাতে প্রবেশ না করে তার। ব্যবস্থা নিতে হয়। ঘেরে প্রবেশ করানো পানিতে একর প্রতি ১০ - ২০ হাজার বাগদার পোনা মজুদ করা যায়।
প্রতি সপ্তাহে ঘেরের ৫০% পানি পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে। আবার বৃষ্টির সময় উপরিস্তরের পানি বের করে দেওয়া। ভালো। মেরে পোনা ছাড়ার ২-৩ মাসের মধ্যে বেশ বড় হয় এবং তখন সম্পূরক খাবার দিতে হয়। চিংড়ির জন্য পানিতে বেশি অক্সিজেন দরকার হয় বলে ঘেরের পানি পোনা ছাড়ার ৩ মাস পর হতে প্রতি সপ্তাহে ২ বার করে পানি বদলাতে পারলে ভালো হয়। এভাবে চাষ করলে একরে ৫০০ ৬০০ কেজি বাগদা উৎপাদন হতে পারে।
৩. সেমি ইনটেনসিভ বা আধা নিবিড় পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পূর্বোক্ত পদ্ধতি অপেক্ষা প্রায় ৩০ গুণ বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। এখানে (ক) জোয়ার-ভাটার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, (খ) ঘেরে মিশ্র পোনা যেন ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে, (গ) ঘেরে ইনলেট ও আউটলেটে ঘন ফাঁসের জাল ব্যবহার করে মিশ্র পোনার প্রবেশ ঠেকাতে হবে, (ঘ) ঘেরের পানি নিয়মিত পাল্টাতে হবে, (৩) পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, (চ) পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি ও পানি প্রবেশ করানোর পাশাপাশি সম্পূরক খাবার দিতে হবে, (ছ) পানির লবণাক্ততার মান বজায় রাখতে হবে, (জ) পানির গভীরতা ঠিক রাখতে হবে, (ঝ) চিংড়ির রোগবালাই দেখা দিলে চিকিৎসা করতে হবে, (ঞ) পুকুরের পানির তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য পানি প্রবেশ ও বের করে দিতে হবে, (ত) রাক্ষুসে মাছ ঘেরে যেন না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে, (খ) পোনার ওজন ১-১০ গ্রাম পর্যন্ত দেহের ওজনের ৮-১০%, ১০ গ্রামের বেশি প্রজনের জন্য ৫%, ২০ গ্রাম বা বেশি ওজনের জন্য ৪-৫% পরিমাণ সম্পূরক খাবার দিতে হয়। এ পদ্ধতির জন্য একরে ৮০ হাজার ১ লাখ পোনা মজুদ করা যায়। এবং ২য় মাস থেকে ঘেরে খাদ্য দিতে হয়।
৪. নিবিড় চিংড়ি চাষ পদ্ধতি: প্রতি বর্গমিটারে ৩০-১০০টি পোনা ছাড়া যায় এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনায় একরে ১০,০০০ কেজি পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানা যায়।
উপকূলীয় এলাকায় পোনা সংগ্রহ ও বাছাই করা :
উপকূলীয় এলাকার জলাশয়ে, নদীর মোহনা ও সমুদ্র তীরে প্রচুর চিংড়ি পোনা পাওয়া যায়। সমুদ্রের জোয়ারের সাথে নদীর মোহনায় ও জলাশয়ে বিভিন্ন জাতের পোনা ঢুকে পড়ে। পোনা ধরার বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে মোহনার কাছাকাছি অঞ্চল থেকে চিংড়ির কিছু ভালো পোনা সংগ্রহ করা হয়।
উপকূলীয় এলাকার লোনা পানিতে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। বাগদা মা চিংড়ি গভীর সমুদ্রে বাস করে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তারা ডিম পাড়ে। চিংড়ির প্রজনন ও ডিম নিষিক্তকরণ সমুদ্রেই হয়ে থাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ১০ - ১৫ মি. মি. দৈর্ঘ্যের প্রচুর পরিমাণে পোনা জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসে। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের সময় চাষীরা বিভিন্নভাবে পোনা সংগ্রহ করে থাকে।
তবে শিকারি জালের সাহায্যে পোনা ধরে সেখান থেকে বাগদা চিংড়ির পোনা বাছাই করে আলাদা একটি পাত্রে রেখে খামারে ছাড়া হয়। অনেক সময় জোয়ারের পানি উপরে উঠে বিভিন্ন গর্তে আটকে যায়। সেখান থেকে মগ দ্বারা পানি তুলে ছাঁকনি জালের সাহায্যে চিংড়ির পোনা আলাদা পাত্রে করে খামারে ছাড়া হয়। আবার ঠেলা জাল দিয়ে জোয়ারের স্রোতের অনুকূলে ও প্রতিকূলে জাল ঠেলে ঠেলে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে খামারে ছাড়া হয়।
মোহনা হতে যেভাবেই পোনা সংগ্রহ করা হোক না কেন তা খামারে ছাড়ার আগে বাছাই করে নেওয়া হয়। বাগদা চিংড়ির পোনার পিঠের মাঝখানটায় লাল একটা রেখা থাকে। বড় হলে তা মিশে যায়। বাগদার পোনা সাঁতার কাটার সময় দেখতে অনেকটা জেট বিমানের মতো দেখায়। আর শরীর লম্বা ও সরু। মাথার খোসার সাথে সংযুক্ত থাকে রোস্ট্রাম এবং এই খোসার অংশকে কৃত্তিকাবর্ম বলে।
এছাড়া যে পাত্রে পোনা সংগ্রহ করা হয়, তার মধ্যে যদি লতাপাতা, ঘাস বা ছোট ডাল ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে বাগদার পোনাগুলো তাদের জড়িয়ে ধরে। এভাবে পোনা চিনে আলাদা করতে হয়। কৃত্তিকাবর্ম দেহাপেক্ষা ছোট হলে সেটি ভালো পোনা।
চিংড়ির খাদ্য ব্যবস্থাপনা: উপকূলীয় এলাকায় খামারে প্রবেশ করানো জোয়ারের পানিতে যথেষ্ট প্রাকৃতিক খাবার থাকে। কিন্তু খামারে যখন প্রচুর পোনা ছাড়া হয়, তখন খাদ্যের ঘাটতি দেখা যায়। তাই বাহির হতে খাদ্য দিতে হয়। চিংড়ির দেহের বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও চর্বি জাতীয় পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রয়োজন। আর দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য খাবারে ৪০- ৬০% প্রোটিন দেওয়া ভালো।
চিংড়ির খাদ্যাভ্যাস: বাগদা চিংড়ি পানির তলার দিকে অবস্থান করে এবং খাবার সময় একটু একটু করে খুটে খুটে খায়। এরা বিরামহীনভাবে খাদ্য খেয়ে থাকে। পোনা ছোট অবস্থায় গুঁড়া খাবার দিতে হয়। একটু বড় হলে পিলেট বা বড়ি আকারের খাদ্য দিলে ৪ ৬ ঘণ্টার মধ্যে খেয়ে শেষ করতে দেখা যায়।
শেওলা মিশানো সয়াবিন ও আটার তৈরি খাবার পানিতে ৭২ ঘণ্টা ভালো থাকে। মাংসের ছাঁট আটার সাথে গুলি পাকিয়ে দিলে পানিতে ৬ ঘণ্টা ভালো থাকে। খাদ্যের পরিমাণ: চিংড়ির ওজন ০.৫ গ্রাম হলে একর প্রতি ৮০,০০০ পোনার জন্য (৮০,০০০x০.৫) এর ১০ ভাগের ১ ভাগ (দৈহিক ওজনের ১০%) = ৪০০০ গ্রাম = ৪ কেজি।
তাছাড়া ১০ গ্রাম ওজনের পোনার জন্য (৮০,০০০ গ্রাম × ১০ = ৮,০০,০০০ গ্রাম = ৮০০ কেজির ৫%) ৪০ কেজি প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। বাগদা চিংড়ি সংগ্রহ: খামারে চিংড়ির পোনা ছাড়ার ৪ মাস পরেই বা চিংড়ির ওজন ২৫ ৩০ গ্রাম হলেই সংগ্রহ করা যায়।
আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। উপকূলীয় এলাকায় এককভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।
comment url