চিংড়ির পরিচিতি গলদা চিংড়ি ও বাগদা চিংড়ি

আচ্ছালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - দৈনিক শিক্ষা ব্লগর পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে চিংড়ির পরিচিতি গলদা চিংড়ি ও বাগদা চিংড়ি নিয়ে আলোচনা করব।

চিংড়ির পরিচিতি গলদা চিংড়ি ও বাগদা চিংড়ি

চিংড়ির পরিচিতি (গলদা ও বাগদা)

চিংড়ির পরিচিতি (গলদা ও বাগদা) [Identification of shrimp (Giant prawn and giant tiger prawn)] চিংড়ি প্রজাতি সাধারণত দু'ভাগে বিভক্ত। যথা- পিনাইড ও পিনাইড বহির্ভূত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে প্রধানত যে প্রজাতির চিংড়ি আমদানি করে তার মধ্যে মিঠাপানির গলদা (পিনাইড বহির্ভূত) ও লোনা পানির বাগদা (পিনাইড) চিংড়ি উল্লেখযোগ্য। গলদা চিংড়ি' বিশ্বে "Giant fresh water prawn এবং বাগদা চিংড়ি "Gaint tiger prawn হিসেবে পরিচিত। এদের বৈশিষ্ট্য হলো-

পিনাইড: মাথা দেহের ওজনের প্রায় ১/৩ অংশ। চিংড়ির মাথার সামনের দিকে করাতের ন্যায় দাঁত বিশিষ্ট অঙ্গটি রোস্ট্রাম। রোস্ট্রামের নিম্নাংশে দাঁতের সংখ্যা কম। এদের আবাসস্থল সমুদ্রে ও ঈষৎ লোনা পানিতে। প্রজননের সময় বেশির ভাগ প্রজাতি সমুদ্রের লোনা পানিতে চলে যায় এবং লার্ভা (পিএল) অবস্থায় উপকূলীয় এলাকায় চলে আসে।

পিনাইড বহির্ভূত/নন পিনাইড: মাথা দেহের ওজনের প্রায় ৫০%। রোস্ট্রামের উপরে ও নিম্নাংশে দাঁতের সংখ্যা বেশি। এদের আবাসস্থল মিঠাপানিতে। তবে প্রজননের সময় কিছু প্রজাতি ঈষৎ লোনা পানিতে চলে আসে।

গলদা চিংড়ি (Giant prawn)

গলদা চিংড়ি মিঠা পানিতে বাস করে। নদ-নদী, খাল-বিলে এদের প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এরা আকারে বেশ বড় হয়। একটি গলদা চিংড়ি ওজনে ২৫০-৪০০ গ্রাম হয়ে থাকে।

দৈহিক বৈশিষ্ট্য: গলদা চিংড়ি সাধারণত হালকা নীল কিংবা হালকা সবুজ বর্ণ থেকে বাদামি বা কালচে বর্ণের হয়। এর পোনার ক্যারাপাসের খোলসে ২-৫টি কালচে আড়াআড়ি দাগ থাকে। রোস্ট্রাম লম্বা ও বাঁকানো এবং উপরে ও নিচে খাঁজ কাটা থাকে।

রোস্ট্রামের উপরিভাগে পুরুষ গলদার ক্ষেত্রে খাঁজ সংখ্যা ১২-১৫টি ও নিচের দিকে ১১-১৪টি থাকে। স্ত্রী গলদার ক্ষেত্রে উপরের দিকে ১২-১৩টি এবং নিচের দিকে ৫-৭টি খাঁজ থাকে। গলদা চিংড়ির শিরঃবক্ষ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য চিংড়ির চেয়ে বড়। গলদার পা বেশ লম্বা, ১ম ও ২য় জোড়া পা মোটা ও চিমটাযুক্ত।

পায়ের বর্ণ নীলাভ ও কিছুটা কালচে হয়ে থাকে। পুরুষ গলদার পা স্ত্রী গলদা অপেক্ষা তুলনামূলকভাবে বড়। গলদা চিংড়ির উদরের দ্বিতীয় প্লিউরা প্রথম ও তৃতীয় প্লিউরাকে আংশিকভাবে আবৃত করে রাখে। একটি স্ত্রী চিংড়ি ৫৪,০০০-২,৭৬,০০০টি ডিম ধারণ করতে পারে। চিংড়ির অধিকাংশ কার্যক্রম রাতে ঘটে থাকে। যেমন- খাদ্য গ্রহণ, খোলস পাল্টানো, সংগম করা ও ডিম পাড়া।

গলদা চিংড়ি (Giant prawn)

প্রজনন সময়কাল: গলদা চিংড়ি প্রায় সারা বছর প্রজননে সক্ষম হলেও ডিসেম্বর থেকে জুলাই মাসই গলদার প্রজননকাল। তবে মে-জুন মাসে উপকূলের নদীগুলোতে বেশি পোনা পাওয়া যায়।

গলদা চিংড়ির জীবন বৃত্তান্ত: গলদা চিংড়ির জীবন প্রধানত ৪টি ধাপে বিভক্ত। যেমন- ডিম, লার্ভা, পোস্ট লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি। ডিম: গলদা চিংড়ি ৫-৬ মাসের মধ্যেই-পরিপক্ক হয়। তবে অনুকূল পরিবেশে ও খাদ্য প্রাপ্তির ওপর উপযুক্ত সময় কিছুটা নির্ভরশীল।

স্ত্রী চিংড়ির জননতন্ত্র ক্যারাপেসের নিচে থাকে ও ডিম পাড়ার ২-৩ দিন আগে এটি কমলা রং ধারণ করে। স্ত্রী-পুরুষ চিংড়ি মিলনের ১০-১২ ঘণ্টার মধ্যে স্ত্রী চিংড়ি ডিম ছাড়ে। ডিমগুলো বের হওয়ার পথে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়।

নিষিক্ত ডিমগুলো পেটের তলায় সন্তরণ পদের মধ্যে অবস্থান নেয় এবং এক প্রকার আঠালো রসের সাহায্যে আটকে থাকে। এ অবস্থায় তারা সন্তরণ পা নেড়ে ডিমে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করে। ডিমগুলো এ অবস্থায় স্ফুটনের আগে সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহ থাকতে পারে।

৫০-১০০ গ্রাম ওজনের একটি প্রাপ্তবয়স্ক চিংড়ি ৮০,০০০-১,০০,০০০ ডিম পাড়তে পারে। তবে পরিপক্বতার প্রাথমিক স্তরে এ সংখ্যা ৫,০০০-২০,০০০টি হয়। ডিমের রং প্রথমে কমলা বর্ণের হয়। ১০-১২ দিনের মধ্যে কালচে ধূসর রং ধারণ করে। ২৮° সে. তাপমাত্রায় ডিম ফুটতে প্রায় ১৮-২১ দিন সময় লাগে।

গলদা চিংড়ির ডিম সবসময় রাতের বেলায় ফোটে। ডিম ফোটার পর স্ত্রী চিংড়ি সন্তরণ পা নেড়ে লার্ভাগুলোকে পানিতে ছড়িয়ে দেয়। ডিম থেকে লার্ভা বের হতে ২ রাত পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

লার্ভা : লার্ভা দেখতে অনেকটা পোকার মতো। এরা লেজ উপরে এবং মাথা নিচে রেখে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকে। এ অবস্থায় তারা আধা লবণাক্ত (১২-১২ পিপিটি) পানিতে অবস্থান করে এবং প্রাণিকণা খেতে শুরু করে। লার্ভা অবস্থা শেষ হতে ৩০-৪৫ দিন পর্যন্ত ১১টি পর্যায় অতিক্রম করে ১২ টা তম পর্যায়ে পোস্ট লার্ভায় উপনীত হয়।

পোস্ট লার্ভা : পোস্ট লার্ভায় পৌছার পর এদের স্বভাব পরিবর্তন হয়। তখন তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির মতো দেখায় এবং নদীর তলদেশে হামাগুড়ি দিয়ে চলে। এ অবস্থায় তারা অপেক্ষাকৃত বড় খাদ্য টুকরা (উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ) খেতে পারে।

পোস্ট লার্ভা অবস্থায় আসার ৭-১৫ দিনের মধ্যে (১.৫ সেমি.) এরা মিঠা পানির দিকে চলে আসতে শুরু করে। এ অবস্থায় নদীর স্রোতের বিপরীতে নদীর পাড় দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। প্রায় ৩০ দিনের মধ্যে পোস্ট লার্ভা কিশোর চিংড়িতে (৩ সেমি.) পরিণত হয়।

২-৩ মাস বয়সে (৬-৭ সেমি.) এরা তরুণ এবং আরও ৩-৪ মাস পরে প্রাপ্তবয়স্ক চিংড়িতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ ৭-১০ মাসে গলদা চিংড়ি আহরণের উপযুক্ত হয়। পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি: ১১টি ভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে লার্ভা পূর্ণাঙ্গ চিংড়িতে পরিণত হয়। প্রথম পর্যায়ে চক্ষুর আগা থেকে লেজের শেষ মাথার দৈর্ঘ্য ২ মিমি. এর কম থাকে। রূপান্তরের সময়ে এর দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৭ মিমি.।

চিংড়ির দেহ খোলস দ্বারা আবৃত থাকে। খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমেই চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে থাকে। চিংড়ির বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে পুরাতন খোলস খসে পড়ে এবং নতুন খোলসের সৃষ্টি হয়। চিংড়ির খোলস বদলানোর এ প্রক্রিয়াকে একডাইসিস (Ecdysis) বলে। এ প্রক্রিয়াও সাধারণত রাতেই ঘটে। ছোট অবস্থায় নতুন খোলস শক্ত হতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে এবং বড় অবস্থায় শক্ত হতে ১-২ দিন সময় লাগে।

খোলস বদলানোর সময় চিংড়ি শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে। লার্ভা অবস্থায় ১-১.৫ মাসের মধ্যে চিংড়ি ১১ বার খোলস পরিবর্তন করে থাকে। গলদা চিংড়ি জুভেনাইল (পোনা) অবস্থায় ৫-১০ দিন অন্তর একবার এবং বড় অবস্থায় ২০-৪০ দিনে একবার খোলস ছাড়ে। চিংড়ির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে খোলস বদলানোর সময়ের ব্যবধানও বাড়তে থাকে। 

বাগদা চিংড়ি (Giant tiger Prawn)

বাগদা চিংড়ি লোনা পানিতে বাস করে। বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকাসহ বঙ্গোপসাগর বাগদা চিংড়ির বিচরণ ক্ষেত্র।

দৈহিক বৈশিষ্ট্য: এরা হালকা বাদামি বা সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। বাগদা চিংড়ির গায়ে বাঘের মতো কালচে ডোরা কাটা দাগ থাকে বলে এদেরকে জায়েন্ট টাইগার বলা হয়। বাগদার ইউরোপড়ে দু'টি ঘন নীল বর্ণের ডোরাকাটা দাগ থাকে।

বাগদার পোনার দেহের সম্মুখ ভাগ থেকে পশ্চাদ ভাগ পর্যন্ত লালরেখা দেখা যায়। কিন্তু পোনা একটু বড় হলে দাগটি হঠাৎ সবুজ রঙের হয়ে যায়। এর রোস্ট্রামটি বাঁকা ও প্রশস্ত। রোস্ট্রামের উপরের দিকে ৮টি ও নিচের দিকে ৩টি খাঁজ থাকে। একটি স্ত্রী চিংড়ি ২,৪৮,০০০-৮,১১,০০০টি ডিম নিষ্কাশন করতে পারে।

বাগদা চিংড়ির জীবন বৃত্তান্ত:

  • ভ্রূণ (Embryo): নিষিক্ত ডিম গোলাকৃতির, সবুজ হলুদাভ স্বত্রে বর্ণের। ডিমের ব্যাস ০.২৭-০.৩১ মিমি, তবে গড় ব্যাস ০.২৯ মিমি.। ডিম থেকে লার্ভা বের হওয়ার আগে ডিমের ভিতর নড়াচড়া বুঝা যায়। ভ্রূণের বিভাজন শুরু হয়ে ৪ ধাপে রূপান্তরিত হয়। যেমন- প্রথমে ২ কোষ, পরে ৪ কোষ, মরুল এবং নপলিয়াস।
  • লার্জী: বাগদা চিংড়ির লার্ভার বিভিন্ন ধাপ এবং রূপান্তরিত হতে বিভিন্ন মেয়াদের সময় লাগে। যেমন- ১.৫ দিন নপলিয়াসের ৬টি ওর, ৫ দিন প্রটোজুইয়ার ৩টি স্তর, ৪-৫ দিন মাইসিসের ৩টি স্তর এবং ৬-১৫ দিন মেগালোপার ৪টি ওর।
  • লার্ভার সাঁতার কাটা এন্টিনার প্রোপালশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এরা সাঁতার কাটে। প্রটোজুইয়া স্তরে এন্টিনেল এবং বক্ষীয় প্রোপালশনের মাধ্যমে, মাইসিস স্তরে বক্ষীয় মাংসপেশির সংকোচন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে এবং মেগালোপা স্তরে উদর পেশীয় মাংসপেশি প্রোপালশনের মাধ্যমে সাঁতার কাটে। প্রটোজুইয়া ও মাইসিস স্তরকে একত্রে জুইয়া বলা হয়। মেগালোপা ও জুভিনাইল পর্যায়ের প্রথম স্তরকে বলা হয় পোস্টলার্ভা। চিংড়ির পোনাকে পি.এল বা ফ্রাই বলা হয়। মেগালোপ স্তরে কেরাপোসের দৈর্ঘ্য ১.২-২.২ মিমি হয় এবং এ স্তরের শেষ পর্যায়ে পুকুরে প্রতিপালন করা যায়।
  • জুভিনাইল। এ স্তরের প্রথম পর্যায়ে দেহ স্বচ্ছ বর্ণের হয়ে থাকে। এ স্তরের প্রথম পর্যায়কে পোস্ট লার্ভা বা ফ্রাই এবং শেষ পর্যায়কে ফিঙ্গারলিং বলা হয়। চিংড়ির পোনার শিরোবক্ষ খোলস যখন ০.৭ মিমি, হয়, তখন দেহ কালো বর্ণ। ধারণ করে এবং রোস্ট্রামের উপরিভাগে ৬টি ও অন্তীয় দেশে ২টি দাঁত দেখা যায়। যখন শিরোরক্ষ খোলস ৩.৭ মিমি. হয় তখন দেহ আরো কালো হয় এবং মোটা হতে থাকে। তবে শিরোবক্ষ খোলস ২.২ মিমি এর কিছুটা বেশি হয়ে থাকলে হামাগুড়ি দেয় ও সাঁতার দেওয়া শুরু করে।
  • কিশোর চিংড়ি: এ অবস্থায় দেহ পূর্ণাঙ্গ মতো বা কিছুটা বড় দেখায় (গড়ে ০.৫৮ মিমি)। শিরোবক্ষ দৈর্ঘ্য ১১ এমএম এর সময় জননেন্দ্রিয় শনাক্ত করা যায়। যখন শিরোবক্ষ দৈর্ঘ্য ১১-৩৪ মিমি, হয়, তখন পুংজননেন্দ্রিয় বুঝা যায় এবং স্ত্রী চিংড়ির শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য যখন ৩৭ মিমি, এ পৌছায় তখন স্ত্রী জননেন্দ্রিয় বুঝা যায়।
  • তরুণ চিংড়ি: এ পর্যায়ে শরীরের গঠন বড় দেখায়। পুরুষ চিংড়ির শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য ৩৭ এবং স্ত্রী চিংড়ির শিরোবক্ষ খোলসের দৈর্ঘ্য ৪৭ মিমি, এ পৌছায় তখন প্রথম মিলনে লিপ্ত হয়। এ পর্যায়ে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার আগে মোহনা বা অভ্যন্তরীণ এলাকায় মিলন হয়ে থাকে।
  • পূর্ণাঙ্গ চিংড়ি: এ সময় দেহের সকল অঙ্গ পরিপূর্ণ থাকে এবং তাদের মিলন একাধিকবার হয়ে থাকে। পুরুষ বাগদার গড় আয়ু ১-১.৫ বছর এবং স্ত্রী বাগদার গড় আয়ু প্রায় ২ বছর।

আপনার আসলেই দৈনিক শিক্ষা ব্লগর একজন মূল্যবান পাঠক। চিংড়ির পরিচিতি গলদা চিংড়ি ও বাগদা চিংড়ি এর আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

Next Post Previous Post
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url